Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 11:03 pm

বিজয় নিশান উড়ছে ওই

কাজী সালমা সুলতানা: ১ ডিসেম্বর ১৯৭১, বুধবার। এ সময় মুক্তিযুদ্ধ সর্বাত্মক রূপ পায়। একের পর এক প্রবল আক্রমণের মুখে পিছু হটতে থাকে পাকিস্তানি

সেনাবাহিনী। এরই মধ্যে পাকিস্তানি সৈন্য, বিহারি ও রাজাকার-আলবদরদের তৎপরতাও বৃদ্ধি পায়। এদিন বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল ও নোয়াখালী রণাঙ্গনে দুর্বার মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদল উপর্যুপরি আক্রমণ চালিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীও বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের কারণে বাংলাদেশে অনেক মুক্তাঞ্চল সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের এসব সংবাদ ফলাও করে প্রচারিত হতে থাকে। এসব সংবাদে মুক্তিপাগল বাঙালি আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।

এদিন শেষরাতে মুক্তিবাহিনী সিলেটের শমসেরনগরে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনীকে নাজেহাল করে তোলে। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে পাকবাহিনী এই এলাকা থেকে পালাতে শুরু করে। মুক্তিবাহিনী টেংরাটিলা ও দুয়ারাবাজার মুক্ত ঘোষণা করে।

এই দিনে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ জোরদার করেছে। এর ফলে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের নির্দেশে সামরিক বাহিনীর লোকরা আবার গ্রামবাসীদের হত্যা এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার বর্বর অভিযান শুরু করে। বুড়িগঙ্গার অপর পাড়ে গেরিলা সন্দেহে জিঞ্জিরার অন্তত ৮৭ জনকে সামরিক বাহিনীর লোকরা হত্যা করে, যাদের অধিকাংশই যুবক। নারী ও শিশুরাও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। রাঙামাটি ব্যাপটিস্ট মিশনে হানাদার বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে চার্লস আর হাউজার নামে এক ধর্মযাজক এবং বহু বাঙালি সন্ন্যাসিনী নিহত হন। এদিন কুষ্টিয়ার নিকটবর্তী মুন্সীগঞ্জ ও আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের মাঝখানে মুক্তিযোদ্ধাদের মাইন বিস্ফোরণে পাকসেনাবাহী ট্রেন বিধ্বস্ত হয়। এতে বহু পাকসেনা হতাহত হয়।

এদিনে গভীর রাতে মুক্তিবাহিনীর সন্ধানে আলবদর ও পাকসেনা পাবনার নাজিরপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে। এরপর পাকসেনারা গ্রামটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পাকসেনা ও আলবদর সদস্যরা ব্যাপকভাবে লুটপাট চালায় এবং গ্রামের মহিলাদের ধর্ষণে মেতে ওঠে। পরে এই এলাকার শতাধিক ব্যক্তিকে হাত ও চোখ বেঁধে পার্শ্ববর্তী পাবনা-পাকশী সড়কের উত্তর দিকে নিয়ে আসে এবং একটি খালের পাড়ে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। এদিন কুমিল্লার কসবা রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধে ৬০ জনের বেশি পাকসেনা নিহত হয়। সিলেটে কানাইঘাটে এদিন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধে ৩০ পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। ছাতক শহরে যুদ্ধে ৬৫ রাজাকার নিহত হয়। এছাড়া এদিন মুক্তিযোদ্ধারা সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার মুক্ত করেন।

ডিসেম্বর থেকেই মুক্তিপাগল বাঙালি বুঝতে পারে, তাদের বিজয় সুনিশ্চিত। তাই জোরদার হতে থাকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ। এদিন রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান সরকারের এক মুখপাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের বিষয়ে বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি জানান, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শেষ হয়নি। এদিন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্ট বক্তৃতায় উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য অপসারণের জন্য ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান। এদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এমন পশ্চাদপসরণের সময়েও রাজাকার, আলবদর ও স্বাধীনতাবিরোধীদের অপতৎপরতা থেমে থাকেনি। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষনেতা যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম এদিন বৈঠক করেন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে। বৈঠকে তিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগের দাবি তোলেন। গোলাম আযম কমিউনিস্টদের ‘অপতৎপরতা’ সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেন। এদিন মিত্রপক্ষ ভারতের হামলার প্রতিবাদে খুলনায় হরতাল পালন করেন শান্তি কমিটির সদস্যরা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সর্বাত্মক সহায়তা করে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে গঠন করা রাজাকার বাহিনী। এদিন জাগ্রত বাংলা পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করা হয়, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে যুদ্ধচলাকালে বাংকারে আশ্রয় নিতে গিয়ে সাপের কামড়ে পাঁচ পাকিস্তানি সৈন্য প্রাণ হারায়। এদিন মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকায় আক্রমণ চালিয়ে দুই মুসলিম লীগ নেতাকে হত্যা করেন এবং অপর দুজন আহত হন। এদিকে এএফপি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এদিন ঢাকায় বোমা হামলায় পিপলস পার্টির অফিস ধ্বংস হয়ে গেছে, যে অফিসটি কিছুদিন আগে জুলফিকার আলী ভুট্টো উদ্বোধন করেন। এদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাঙামাটিতে ব্যাপ্টিস্ট মিশনে আক্রমণ করে যাজক চার্লস আর হাউজারকে এবং সেখানে আশ্রয় নেয়া বাঙালিদের হত্যা করে।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর