পারভীন লুনা,বগুড়া: মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করায় পাকিস্তান সরকারের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন আব্দুল জলিল। দেশ স্বাধীন হলে তিনি চাকরি ফিরে পেলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি স্বাধীনতার ৫০ বছরেও। বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিলের বাড়ি গাবতলী উপজেলার সর্দ্বনকুটি গ্রামে। বর্তমানে তিনি নিজ গ্রামেই অবসর জীবন যাপন করছেন।
১৯৭১ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে আব্দুল জলিল চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের চাকুরিতে ২ মার্চ থেকে অনুপস্থিত থাকেন। মুক্তিকামী জনতার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। একারণে পাক সরকারের আজ্ঞাবহ কালেক্টর অব কাস্টমস ২মার্চ, ১৯৭১ হতে তাঁকে চাকুরি হতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেন। ৯মাস মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি চট্রগ্রাম কাস্টমস হাউসে চাকুরিতে যোগদেন। মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মচারি হিসেবে আব্দুল জলিল চাকুরিতে সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। তবে আজও তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভূক্ত হতে পারেননি।
৭ মার্চ, ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আব্দুল জলিল বাঙালির অধিকার আদায়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাঙালি টগবগে যুবক জলিল চট্রগ্রাম হাউসের চাকুরি ছেড়ে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। পাক সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে চট্রগ্রামের সিজিএস কলোনীর উত্তর-পশ্চিম কোণে জি-১৫/এ/১৫ তিনতলা বাড়ির মাটির নিচে অস্ত্র-শস্ত্র মজুদ গড়ে তোলেন। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ও গণপরিষদ সদস্য মো. ইসহাকের নির্দেশনায় এই বাড়ি থেকে গেরিলাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করা হতো। গেরিলাদের সংগঠিত, ক্যাম্প স্থাপন, খাদ্য, ওষুধ সরবরাহ, আশ্রয়দান কাজে সহায়তা করায় গণপরিষদ সদস্য (এমসিএ) মো. ইসহাকের ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭২ তারিখে প্রত্যয়নপত্র প্রদান করেন।
বগুড়া জেলা সদর হতে ১৬ কি.মি. দূরে গাবতলী উপজেলার সর্দ্ধনকুটি গ্রামে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বাস করেন। গাবতলী উপজেলার সোনারায় গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৬২ সালে মেট্রিক পাস করেন দিনাজপুরের হাকিমপুর বোলদার হাইস্কুল থেকে। এরপর তিনি ১৯৬৪ সনের ১৯ আগস্ট চট্রাগ্রাম কাস্টমস হাউসে সী কাস্টমসের এলডিসি পদে যোগ দেন। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর তিনি চট্রগ্রাম সিটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। এ সময় বাঙালির স্বাধিকার, স্বায়ত্বশাসন, শোষণ, নিপীড়ণ-নির্যাতন ও পশ্চিমাদের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে পূর্বপাকিস্তানে জনতার আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। কলেজে ছাত্রদের আন্দোলন তাঁকে প্রবলভাবে নাড়া দেয় ও মুক্তির চেতনায় তিনি উদ্বুদ্ধ হন। ’৬৯ এর গণঅভ্যুথ্থানের সময় তিনি স্নাতক ডিগ্রীলাভ করেন ঐ কলেজ থেকে। ’৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে বাঙালির স্বাধিকারের পক্ষে তিনি নৌকা মার্কার প্রার্থী মো. ইসহাককে ভোট দেন। ‘৭১ এ এলএলবি পরীক্ষা তিনি বর্জন করেন।
বাঙালি নিধনযজ্ঞ শুরু হলে গোপনে আব্দুল জলিল তাঁর সরকারি কোয়ার্টারের মাটির নিচে গ্রেনেড, বিস্ফোরকসহ অস্ত্র-শস্ত্র লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেন। এই বাড়িতে খাদ্য, ওষুধপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জাম, কাপড়-চোপড়ের মজুদ গড়ে তোলা হয়। মূলত: মুক্তিযুদ্ধকালিন এই বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রানজিট ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার হয়। এই ক্যাম্প হতে ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য যুবকদের প্রেরণের ব্যবস্থা করা হতো। এই ক্যাম্পে অবস্থানকারী ব্যক্তিগণের মধ্যে ছিলেন, সোনাতলার দিগদাইড় গ্রামের প্রকৌশলী প্রয়াত ওয়াজেদ আলী (খোকা)। তিনি চট্ট্রগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের রসদ, উপকরণ ও নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহকারি ছিলেন। পাঞ্জাবী ভাষায় পারদর্শী ওয়াজেদ আলী চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট হতে পাকবাহিনীর খবরাখবর এই বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করতেন। এখান থেকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হতো।
আব্দুল জলিল বলেন, তোছাদ্দক হোসেন নামের কাস্টমস হাউসের প্রিন্সিপ্যাল দায়িত্বপ্রাপ্ত এক ব্যক্তি ও সোনাতলা উপজেলার দিগদাইড় গ্রামের ফজলুল করিম তাঁর বাসায় গোপনে যাতায়াত করে পাকবাহিনীর সংবাদ পৌঁছে দিতেন। মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম নেভী হাউসের কমান্ডিং অফিসার সিদ্দিকীর সাথে তিনি গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং নৌবাহিনীর বাঙালি অফিসার সিদ্দিকী তাঁর এই বাসায় গোপনে যাতায়াত করতেন। এই বাসা থেকে অস্ত্র ও গোলাবরুদ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা গেরিলারা নৌ আক্রমণ করত। নৌবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার সিদ্দিকীর ১৫ এপ্রিল, ১৯৭২ তারিখের প্রত্যয়নে আব্দুল জলিলের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আব্দুল জলিল বলেন, পাক সরকারের পক্ষ ত্যাগ করায় তাঁকে চাকুরি থেকে সাসপেন্ড করা হলে তিনি ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ইসহাক ও গেরিলারা তাঁকে এই গোপন ক্যাম্প দেখভাল করতে বলেন। তাদের অনুরোধে তিনি এই ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করেন। গণপরিষদ সদস্য মো. ইসহাকের দেওয়া প্রত্যয়নে তাঁর কর্মকান্ডের কথা জানা গেল। তিনি ৭ জুলাই, ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের কাজে ভারতে গমন করেছেন বলে কাগজপত্রে প্রমাণ মেলে।
আব্দুল জলিলের গোপন আস্তানার কথা সিজিএস কলোনীর লোকজন জানত না। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে পাকবাহিনী তাঁর বাসায় আক্রমণ করেছিল। তবে গোপনসুত্রে খবর পেয়ে আব্দুল জলিল ও অন্যান্যরা পূর্বেই পালিয়ে যান। পরে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে পাকবাহিনী তাঁর বগুড়া শহরের রহমান নগরের হোল্ডিং নং ৩৬৪ এর বাড়িটি সম্পূর্ণ্ পুড়িয়ে দেয়।
৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ আব্দুল জলিল কাস্টমস হাউসে তাঁর কর্মস্থলে যোগদেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ৯ মাস চাকুরিতে অনুপস্থিত থাকায় তাঁর সাময়িক বরখাস্তকালিন পূর্ণবেতন ১৯৭১ সালেল ১৯ ডিসেম্বর প্রদান করা হয়। পরে কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কালেক্টর জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি চাকুরিজীবী মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি আব্দুল জলিলকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষনা করে।
মুক্তিযোদ্ধা কর্মচারি হিসেবে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের জারীকরা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী আব্দুল জলিলকে চাকুরিতে দুই বছরের জ্যেষ্ঠ্যতা প্রদান করে দুটি অগ্রিম ইনক্রিমেন্ট প্রদান করে বেতন বাড়ানোর নজির রয়েছে সরকারি রেকর্ড ও কাগজপত্রে।
আব্দুল জলিল ২০০৫সালে ইন্সপেক্টর হিসেবে চাকুরি হতে অবসর গ্রহণ করেন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস থেকে। তারপর তিনি বগুড়ায় গ্রামের বাড়িতে বাস করছেন। তাঁর পরিবারে স্ত্রী, ২ ছেলে ও ৩ মেয়ে আছেন। ২ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তাঁর বয়স ৭৫। বার্ধক্য জনিত নানা জটিলরোগে আক্রান্ত এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিপত্র যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত উপজেলা কমিটিতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর আবেদন বিবেচিত হয়নি। উপজেলা কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে করা আপীলের আবেদনের জবাব আজও পাননি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেও তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভূক্ত হতে পারেননি।