Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 8:57 pm

বিটিআরসি’র পর বাংলালিংকের নিরীক্ষায় নামল এনবিআর

রহমত রহমান: গ্রাহক বিচারে একসময়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেসরকারি মোবাইল অপারেটর ছিল বাংলালিংক (বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনস লিমিটেড)। যদিও বর্তমানে কোম্পানিটি রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। বহুজাতিক এ মোবাইল ফোন অপারেটরের রাজস্ব ফাঁকির খোঁজে নিরীক্ষা শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

নিরীক্ষা করতে এনবিআরের আওতাধীন বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ), মূল্য সংযোজন কর থেকে টিম গঠন করা হয়েছে। এ টিমকে ৩০ দিনের মধ্যে নিরীক্ষা শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এর আগে একইভাবে দেশের বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবির ফাঁকির খোঁজে নিরীক্ষা করেছে এলটিইউ। নিরীক্ষায় গ্রামীণফোনের প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ও রবির প্রায় ৯২৫ কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন করে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এনবিআর সূত্র জানায়, বাংলালিংকের রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটনে এনবিআরের নির্দেশে ২২ জানুয়ারি একটি নিরীক্ষা দল গঠন করে আদেশ জারি করা হয়। এলটিইউ’র উপকমিশনার চপল চাকমাকে দলনেতা ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আসিফ আহমেদকে সদস্য সচিব করা হয়। এছাড়া দলের অন্য সদস্যরা হলেন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা পক্সকজ কুমার সাহা, মো. সাদেক হোসেন, মো. উজ্জল হোসেন ও নাজনীন পারভীন। নিরীক্ষা দল বাংলালিংকের পূর্ববর্তী নিরীক্ষার পর থেকে ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত নিরীক্ষা করবে।

নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ, উৎপাদন প্রক্রিয়া, মজুত পণ্য ও সেবা, উপকরণ পরিদর্শনে মূসক আইন অনুযায়ী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের মূসক পুস্তকাদি, বাণিজ্যিক দলিলসহ সব দলিলাদি, হিসাব ও নথিপত্র পরীক্ষাপূর্বক নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আদেশে নিরীক্ষাদলকে বাংলালিংকের নিরীক্ষাকালে অতীত অভিজ্ঞতা, মেধা ও ক্ষেত্রবিশেষে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় আনতে বলা হয়েছে। বিবেচনায় এনে প্রতিষ্ঠানটির যাবতীয় আমদানি-রপ্তানি, স্থানীয় ক্রয়-বিক্রয়সংক্রান্ত হিসাবের কাগজপত্র, প্রাসঙ্গিক দলিল, আয়কর বিভাগসহ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে আড়াআড়িভাবে যাচাইপূর্বক সম্ভাব্য মূসক ও সম্পূরক শুল্ক পরিহারের বছরভিত্তিক পরিমাণ নির্ধারণ করতে এবং বোর্ডের সিআইএস সেল থেকে আমদানি-রপ্তানি তথ্য এনে আড়াআড়িভাবে যাচাই করতে বলা হয়েছে।

নিরীক্ষাদলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, নিরীক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের আগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রোফাইল, উৎপাদন-উপকরণ সহগ-সংক্রান্ত ঘোষণা, ট্রেজারি চালানের কপি অনিষ্পন্ন নিরীক্ষা আপত্তি, বকেয়া ও মামলার তথ্য, নিষ্পন্ন ও অনিষ্পন্ন দাবিনামা, ন্যায় নির্ণয় আদেশসংক্রান্ত তথ্য ও দলিলাদি, আগের নিরীক্ষা প্রতিবেদন ও পরিপালন-সংক্রান্ত তথ্যাদিসহ প্রাসঙ্গিক অন্যান্য দলিলপত্র, নথিপত্র ও তথ্যাদি সংশ্লিষ্ট সার্কেল বা বিভাগীয় দপ্তর থেকে সংগ্রহ করতে হবে।

আরো পড়ুন-তিন বছর ধরে হোল্ডিং ট্যাক্স দিচ্ছে না বাংলালিংক [1]

এতে আরও বলা হয়েছে, গৃহীত রেয়াত বা সমন্বয় যথাযথ কি নাÑপরীক্ষা করে মতামত প্রদানসহ গৃহীত উপকরণ রেয়াতের অনুপাতে উপকরণের মজুদ যথাযথ পরিমাণে আছে কি নাÑতা সরেজমিন কায়িকভাবে পরীক্ষাপূর্বক প্রতিবেদনে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। যে ক্ষেত্রে উপকরণ মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে অথচ বর্ধিত মূল্য মূসক আরোপযোগ্য মূল্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে বর্ধিত মূল্যের ওপর প্রযোজ্য মূসকের পরিমাণ বের করতে হবে। নিরীক্ষা মেয়াদে উপকরণ ক্রয়ের তথ্য যাচাই করতে হবে।

আরো পড়ুনবাংলালিংকে কারিগরি উন্নয়ন ত্রুটিতে গ্রাহকের উটকো ভোগান্তি [2]

যেসব পণ্য বা সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে উৎসে মূসক কর্তনের বিধান রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে যথাযথভাবে উৎসে কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে কি না তা যাচাই করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের ক্রয়-বিক্রয়, আয়-ব্যয়, প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো, সেবা প্রদানের অর্থের আদান-প্রদান, প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব বুকস অব অ্যাকাউন্টস, অডিট রিপোর্ট, ব্যাংক লেনদেন ইত্যাদির আলোকে পরিশোধিত করের যথার্থতা নিরূপণ করতে হবে। নিরীক্ষা প্রতিবেদন ৩০ দিনের মধ্যে কমিশনারের কাছে দাখিল করতে হবে। নিরীক্ষা কার্যক্রম এলটিইউ’র অতিরিক্ত কমিশনার তদারকি করবেন।

আরো পড়ুন- বাংলালিংক গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক [3]

সূত্রমতে, এলটিইউ ছাড়াও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) বাংলালিংকের নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর আগে বিটিআরসি নিরীক্ষা করতে দু’দফা উদ্যোগ নিয়েও তা এগোয়নি। এবার তৃতীয় দফায় বিটিআরসি এ অপারেটরটির বিশেষ নিরীক্ষা করবে। এজন্য কমিশনের সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের কমিশনারকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর আগে ২০১১ সালে বিটিআরসি বাংলালিংকের নিরীক্ষায় গেলেও নিরীক্ষক নিয়োগ বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। ফলে নিরীক্ষা করা যায়নি।

অন্যদিকে, একই ধরনের নিরীক্ষা করে গ্রামীণফোনের কাছে ১২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা ও রবি আজিয়াটার কাছে ৮৬৭ কোটি টাকা পাওনা দাবি করছে বিটিআরসি, যা আদালতে গড়িয়েছে। গ্রামীণফোনের ওপর ১৯৯৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আর রবির ওপর ১৯৯৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নিরীক্ষা করা হয়। বিটিআরসি বলছে, রাজস্ব ভাগাভাগি, করসহ বিভিন্ন খাতে এ টাকা অপারেটর দুটি ফাঁকি দিয়েছে। বাংলালিংকের ওপরও একই সময়কালের জন্য নিরীক্ষা করার কথা ছিল।

এদিকে এলটিইউ’র ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলালিংকের এলটিইউ’র রাজস্ব বকেয়া এক হাজার ৯৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। সাতটি মামলায় এ বকেয়া রয়েছে। এসব মামলা উচ্চ আদালত ও আপিলাত ট্রাইব্যুনালে চলমান রয়েছে। এর মধ্যে সিম রিপ্লেসমেন্ট, স্থান-স্থাপনা ভাড়া, বিধিবহির্ভূত রেয়াত গ্রহণ প্রভৃতি খাতে এ রাজস্ব বকেয়া রয়েছে। তবে গত দুই বছরের মামলায় বকেয়া বিষয়ে জানা যায়নি।

সূত্র আরও জানায়, বাংলালিংকের হিসাব নিরীক্ষা করতে বিটিআরসি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আগ্রহপত্র চেয়ে ইতোমধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এতে বলা হয়, প্রচলিত আইন ও বিধি মেনে বিটিআরসি নিজস্ব ব্যয়ে এ নিরীক্ষা পরিচালনা করবে। অপারেটরের আর্থিক, কারিগরি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সবই নিরীক্ষার আওতায় পড়বে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলালিংকের গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন কোটি ৫২ লাখ ৩৯ হাজার।