ওয়ারেছ আলী খান: শিক্ষাদান নিছক অর্থোপার্জনমূলক কোনো বৃত্তি নয় বরং তা একটি মহান ও বিশেষ ধরনের পেশা। পেশা আর বৃত্তির ব্যবধান বিস্তর। শিক্ষকতাকে পেশার মানদণ্ডে নিতে না পারলে শিক্ষা বিতরণ করা কিংবা সত্যিকার অর্থে একজন আদর্শ শিক্ষক হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। কেউ শিক্ষাদান কর্মে সংযুক্ত হতে চাইলে সর্বাগ্রে তার নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া জরুরি। একজন শিক্ষক হিসেবে প্রাধিকারভিত্তিতে তার জীবিকার জোগান ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রত্যাশার সীমারেখা নির্ধারণ করা আবশ্যক। শিক্ষক কোনো কর্মকর্তা নন; বরং বিদ্যাদাতা। তাই তার কোনো নির্বাহী ক্ষমতার মনোবাসনা থাকা সমীচীন নয়। শিক্ষাগুরুর সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা অন্য পেশাজীবীদের থেকে ভিন্ন। সুতরাং, কেউ প্রকৃত শিক্ষক হতে চায় নাকি প্রচলিত ক্ষমতা কাঠামোর বলয়ে অবস্থান করতে চায়, তা আগেভাগেই তাকে ভেবে নিতে হবে। নির্বাহী ক্ষমতার ইপ্সা থাকলে পেশা বাছাইয়ের শুরুতেই বিকল্প সিদ্ধান্ত নেয়া উত্তম।
অভিভাবকদের বেশির ভাগই ফলাফলমুখী মনোভাবের অধিকারী। যাদের আরোপিত প্রত্যাশার চাপে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিদারুণভাবে পিষ্ট হয়। অনেক সময় শিশুদের যথাযথ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া, আন্তঃপারস্পরিক মিথস্ক্রিয়?ার পরিপক্বতা ও শৈশব উপভোগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। বঞ্চিত শৈশবের জোগান দিয়ে প্রকৃত শিখনের খেই হারিয়ে মানবিক গুণাবলি বিবর্জিত কোনো সামাজিক একক দিয়ে ভবিষ্যৎ নির্মাণের অমূলক ভাবনাও থাকে অনেকের মধ্যে। বিষয়টা অনেকটা এমন, কাঁঠাল গাছে আম ফলানোর প্রচেষ্টা। মানবশিশুর প্রথম পাঠশালা হলো তার পরিবার। পরিবার থেকে অর্জিত শিক্ষা-দীক্ষা, বোধ-বোধি, রীতি-নীতি, নৈতিকতা-আদর্শ ও সামগ্রিক জীবনচারণের প্রভাব অনিবার্যভাবে শ্রেণিকক্ষে প্রতিফলিত হয়। আর এ প্রভাব হয়ে ওঠে বিস্তর ও সুদূরপ্রসারী। মনে রাখা ভালো, পাঠগ্রহণ এবং পাঠদান পরবর্তী প্রক্রিয়ায় পারিবারিক পরিমণ্ডলে অর্জিত এসব বিদ্যা একজন শিক্ষার্থীর জীবনব্যাপী বড় ধরনের পরিবর্তন অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া মানেই ভালো বিদ্যার্জন নয়। উচ্চমাধ্যমিকের চৌহদ্দি পেরিয়ে অনেকেই উচ্চ শিক্ষার কাক্সিক্ষত দোরগোড়ায় যেতে পারে না। এমন মৌলিকত্ব বিবর্জিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ওজনদার সিজিপিএ নির্ভর সনদ দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। ভর্তি পরীক্ষায় কোনো একটি ‘ইউনিটে’ তাই ফেল করে প্রায় ৯০ শতাংশ! বর্তমানে তথাকথিত মোটাদাগের ফলাফলকে শিক্ষার্জনের অন্যতম প্রধান সূচক হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। একজন শিক্ষার্থী কী শিখছে, কীভাবে শিখছে, কেনো শিখচ্ছে সে বিষয়ে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। শুধু স্বাস্থ্যকর জিপিএ হলেই কেল্লা ফতেহ। শিক্ষার সামগ্রিক চিত্রপট বদলের জন্য সর্বপ্রথম এ ভ্রমময় মানসিকতার পরিহার অনিবার্য।
শিক্ষকের মর্যাদা আগেকার সময়ে কোথায় ছিল আর এখন কোথায়-বিষয়টি আর সরলরৈখিক ভাবনায় সংকুলান হয় না! সমাজের প্রতিষ্ঠিত আচরণ কাঠামোতে আজ কতটা বদল! অসহিষ্ণু, অনভিপ্রেত সামাজিক মনোভাবের প্রকটতা আর ক্রমক্ষয়িষ্ণু সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধের বেড়াজালে কাক্সিক্ষত আদর্শিক সমাজকাঠামো আজ পুরোপুরি নাজেহাল। বিত্তের আস্ফালন আর ক্ষমতার অশুভ দৌরাত্ম্য এখন সমাজের অনেক কিছুকেই প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ক্ষমতার দ্বান্দ্বি^ক বাস্তবতা আর পুঁজির অশুভ প্রভাবে শিক্ষকেরা আজ খেইহারা, বেগতিক ও অনুজ্জ্বল। সেই সঙ্গে প্রকৃত শিক্ষাও আজ সুদূরপরাহত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে শিক্ষার পণ্যায়ন ঘটেছে জ্যামিতিক হারে। এখন শিক্ষাকে ‘প্যাকেজ ডিল’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ শিক্ষার্জন ও এর বিতরণ একটি ভিন্নতর মানসিক প্রক্রিয়া। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির, মন-মগজ-হƒদয়ের ত্রিবিধ সম্মিলনে সম্পন্ন হয় পাঠগ্রহণ ও শিক্ষা বিতরণের মহৎ কর্ম। এই পুরো প্রক্রিয়াকে আলাদা করা হলে সেটা হয়ে যায় শিক্ষার নামে প্রাতিষ্ঠানিকতা মাত্র। নির্মল, শুচিশুভ্র ও নিরপেক্ষ অনুভূতিহীন পাঠদান ও পাঠগ্রহণ প্রক্রিয়া প্রকৃতার্থে মৌলিকত্বের খোলসহীন নিস্ফল কর্মের নামান্তর। তদুপরি এক শ্রেণির শিক্ষকসম্প্রদায় ‘প্রাইভেট টিউশন’কে অর্থ উপার্জনের অন্যতম প্রধান উপলক্ষ মনে করে। অর্থের মোহে মোহাবিষ্ট হয়ে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাকে পরিণত করা হচ্ছে ‘প্যাকেজ পণ্য’ হিসেবে। আর তকমা দেয়া হচ্ছে শিক্ষাবাণিজ্যের।
শিক্ষকেরাও রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ। তারা ফেরেশতা নন। তাদের নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করা সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। জীবনের নিরাপত্তা আর সম্মানের ঘাটতি নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থেকে জাতিকে ভালো কিছু দেয়া যায় না। যারা জাতি গড়ার নেপথ্য নায়ক, তাদের মর্যাদা আর নিরাপত্তার প্রশ্নে দায়ি?ত্বশীল কর্তৃপক্ষকে আপসহীন থাকতে হবে। বিত্তের জোরে বিদ্যা কেনার মানসিকতাও পরিহার করতে হবে। শিক্ষা আর শিক্ষাগুরুকে ভিন্ন প্রক্রিয়ার মূল্যায়ন করতে হবে।
কোনো জাতির মেধাবী তরুণরা শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট না হলে সে জাতির কপালে সমূহ দুর্ভোগ আছে। সেজন্যে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় সম্পৃক্ত করা এবং দক্ষ-সৃষ্টিশীল শিক্ষকসমাজ তৈরির জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের তরফ থেকে শিক্ষক তৈরির বিশেষ স্কিম থাকা উচিত। পাশাপাশি, এসব মেধাবী শিক্ষকের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার বিধান ও মর্যাদার নিশ্চায়ন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের ওপর-ই বর্তায়। অন্যথায়, মানহীন অদক্ষ শিখন কারিগরের দ্বারা সৃষ্টকর্মে উৎকৃষ্ট ফল প্রত্যাশা দস্তুরমত অসম্ভব। এতে বরং শিগগির-ই গোটা জাতির ভাগ্যে শনির দশা লক্ষণীয় হয়ে উঠবে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক তারা নাকি পরস্পর পরস্পরের প্রতিপক্ষ? পরস্পরের সম্মিলিত প্রয়াসে শিখন-শিক্ষণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। শিক্ষায় এ ত্রিবিধ যোগ তাই অপরিহার্য এবং অনিবার্য। শিক্ষা মানেই বহুমুখী একীভূত প্রচেষ্টা। এটা বাজারের কোনো পণ্য নয় যে, তা একতরফাভাবে কেবল পুঁজিপতির ব্যাগেই ভরা হবে! সুতরাং, শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ হোক নিরন্তর আনন্দপূর্ণ। শিক্ষকতা পেশা জন্য হোক সম্মান, মর্যাদা আর নিরাপত্তার প্রতীক। শিক্ষাগুরুর শির হোক সমুন্নত, হƒদয় হোক উম্মুক্ত, বক্ষ হোক স্ফীত। তবেই আশা করা যায়, দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।
মুক্ত লেখক