Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 2:42 am

বিদায়ী অর্থবছরে এলসি খোলা কমেছে সাড়ে ২৬ শতাংশ

রোহান রাজিব: ডলার সংকটের কারণে পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হিমশিম খান আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। এতে বিদায়ী অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ এলসি খোলা কমেছে। বিদায়ী অর্থবছরে এলসি খোলা কমেছে প্রায় সাড়ে ২৬ শতাংশ বা ২৫ বিলিয়ন ডলারের। এলসি খোলা কমাতে প্রভব পড়েছে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিতে। গত জুনে বেসরকারি খাতে ঋণে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা বিগত ১৯ মাসের মধ্যে সর্বনি¤œ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৯ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়। আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) খোলা হয় ৯৪ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের তুলনায় এলসি খোলা কমেছে ২৪ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের বা ২৬ দশমিক ৪২ শতাংশ।

ঋণপত্র খোলা কমার পাশাপাশি নিষ্পত্তিও কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭০ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলারের এলসি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) এর পরিমাণ ছিল ৮৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ফলে গত অর্থবছরে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ১৩ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার বা ১৬ দশমিক ৩১ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ডলার সংকট ও কড়াকড়ির কারণে এলসি খোলা কমেছে। এলসি খোলা কমলেও পণ্য আমদানির পরিমাণ কমেনি। পরিমাণ কমলে বাজারে পণ্যের সংকট দেখা দিত। মূলত আগে আমদানি এলসি খোলার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করা হতো না। ফলে আমদানির আড়ালে অনেক অর্থপাচার হতো। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক নজরদারি বাড়ানোর কারণে ওভার-ইনভয়েসিং কমে গেছে। ফলে আমদানির এলসি খোলাও কমেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র সারোয়ার হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, গত অর্থবছরে ২৫ বিলিয়নের মতো আমদানির এলসি খোলা কমেছে। আমদানির এলসি খোলা কমলেও কোয়ান্টিটি কমেনি। কোয়ান্টিটি কমলে মার্কেটে পণ্যের সংকট দেখা দিত। পণ্যের সংকট দেখা দিলে রপ্তানিতে আমাদের নেতিবাচক প্রভাব পড়ত। কিন্তু রপ্তানিতে কোনো ক্ষতি হয়নি, বরং রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় গত অর্থবছরে বেড়েছে।

তিনি আরও বলেন, নানা পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে আমাদের ডলার বাজার উন্নতির দিকে। বাজারে ডলারের লিকুইডিটি বেড়েছে। নিট ওপেন পজিশন পরিস্থিতি ভালো। এছাড়া ক্যাশ হোল্ডিং পরিস্থিতিও উন্নতির দিকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলোর অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে, যা এক বছরে আগে দুই বিলিয়ন ডলার ছিল। আর মার্কেটে ডলারের ক্যাশ হোল্ডিং পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ৯ মিলিয়ন ডলার নেগেটিভ থেকে ৩৭ মিলিয়ন ডলারে পজিটিভ। এছাড়া অনেক দিন পর সামগ্রিকভাবে ব্যাংকগুলোর ডলার ধারনের সীমা নেট ওপেন পজিশন লিমিট (এনওপি) ইতিবাচক ধারায় এসেছে।

এলসি খোলা কম হওয়ায় শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্র আমদানি উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শিল্পে কাঁচামালের এলসি খোলা কমেছে ৩১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ক্যাপিটাল মেশিনারি ৫৬ দশমিক ৯১ শতাংশ, ভোগ্যপণ্য ১৮ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং মধ্যবর্তী পণ্য ৩১ দশমিক ৩৯ শতাংশ এলসি খোলা কমেছে।

ব্যবসায়ীরা বলেছেন, উৎপাদনমুখী শিল্পের কাঁচামালের আমদানি কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। সাময়িক স্বস্তি মিললেও দীর্ঘ মেয়াদে আমদানি কমার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে ডলার সংকটের সময়ে অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখা উচিত।

এলসি কমার প্রভাবে কমল বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি

এদিকে আমদানি কমায় ও নতুন শিল্পঋণের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় বেসরকারি খাতে ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন নতুন করে কোনো প্রকল্প যেমন তারা নিচ্ছেন না, তেমনি আবার শিল্পের নিয়মিত সংস্কার ও সম্প্রসারণও কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে গত জুন শেষে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশে। আগের মাস শেষে যা ১১ দশমিক ১০ শতাংশ ছিল। আর গত বছরের জুন শেষে ছিল ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯৪ হাজার ৯৯ কোটি টাকায়, আগের বছরের জুন শেষে যা ছিল ১৩ লাখ ৫১ হাজার ২৩৬ কোটি টাকার। এ হিসাবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৪২ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকার। ঋণস্থিতির হিসাব হয় সুদসহ। ফলে নিট ঋণ যে এত বেড়েছে তা নয়। বেসরকারি খাতে পরিস্থিতি এ রকম হলেও সরকারের ঋণ বাড়ছে দ্রুত। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকার প্রায় এক লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। আগের অর্থবছর নিয়েছিল ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।

ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ডলার সংকটের কারণে পর্যাপ্ত এলসি খোলা যাচ্ছে না। তাই ব্যাংক থেকে আগের মতো ঋণ নেয়ার প্রয়োজন হয় না। এলসি খোলা কমে যাওয়ায় মূলধনি যন্ত্রের পাশাপাশি শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমে গেছে। এতে বেসরকারি খাতের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। উৎপাদন কমে গেলে রপ্তানি কমে যাবে বলে মনে করেন তারা।

এক্ষেত্রে ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকেও টাকার টানাটানি রয়েছে। ফলে বেছে বেছে ভালো ব্যবসায়ী ছাড়া অন্যদের ঋণ দেয়া প্রায় বন্ধ রয়েছে। ঝুঁকি এড়াতে সব ব্যাংকই এখন এসএমই ও রিটেইল ঋণের দিকে ঝুঁকছে।