Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 12:28 pm

বিদায়ী অর্থবছর উৎপাদন কমলেও ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়েছে ১১%

ইসমাইল আলী: বেসরকারি খাতে স্থাপিত রেন্টাল ও আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ প্রতি বছর বাড়ছে। বিদায়ী অর্থবছর এ খাতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। যদিও এ সময় আইপিপি ও রেন্টাল কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমেছে পাঁচ শতাংশ। সক্ষমতার ৯০ শতাংশ উৎপাদন করার কথা থাকলেও, গত কয়েক বছর ধরে তা ৫০ শতাংশেরও নিচে থাকছে। এভাবেই প্রতি বছর বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হচ্ছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপি খাতে ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় এক লাখ চার হাজার ৯২৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এর মধ্যে আইপিপিগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৭৬ হাজার ২৪২ কোটি আট লাখ টাকা। আর রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে ২৮ হাজার ৬৮৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। ১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, তা দিয়ে তিনটি পদ্মা সেতু ও একটি কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ করা যেত।

১৫ বছরের মধ্যে বিদায়ী (২০২২-২৩) অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে ১৫ হাজার ১৮৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা, যা সর্বোচ্চ। গত অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১১ হাজার ৩৯০ মেগাওয়াট। তবে এ সক্ষমতার মাত্র ৪২ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে আইপিপি ও রেন্টাল কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে চার হাজার ১৯২ কোটি ৩৮ লাখ ইউনিট। যদিও এর আগের অর্থবছর উৎপাদন ছিল বেশি।

২০২১-২২ অর্থবছর রেন্টাল ও আইপিপিগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১০ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট। এর ৪৭ শতাংশ ব্যবহার করা হয় ওই অর্থবছর। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় চার হাজার ৪১৬ কোটি ৯১ লাখ ইউনিট। আর ২০২১-২২ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছিল ১৩ হাজার ৭০০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে পাঁচ দশমিক ০৮ শতাংশ। তবে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়েছে ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

সূত্রমতে, গত ১৫ বছরে বেসরকারি খাতে ১০০টির বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র দরপত্রের মাধ্যমে নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়। যদিও একটি কোম্পানি অংশ নেয়ায় তাতেও কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। ফলে প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি দরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের লাইসেন্স পায় সামিট। বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল আনসলিসিটেড তথা অযাচিত প্রস্তাবের মাধ্যমে। ফলে এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি ধরা হয়েছে।

পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ছিল এক হাজার ৭২০ মেগাওয়াট। সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় এক হাজার ৫০৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মেগাওয়াটের জন্য গড়ে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় ৮৮ লাখ টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৮৭৮ মেগাওয়াট। সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় এক হাজার ৭৯০ কোটি ২০ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মেগাওয়াটের জন্য গড়ে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় ৯৫ লাখ টাকা।

২০১০-১১ অর্থবছর বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ১৬২ মেগাওয়াট। সে সময় ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল দুই হাজার ৭৮৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এতে গড়ে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় ৮৮ লাখ টাকা। তবে ওই অর্থবছরের শেষ দিকে বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করে। তাই গড় ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ তুলনামূলক হ্রাস পায়।

পরের (২০১১-১২) অর্থবছর রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা আরও বেড়ে হয় তিন হাজার ৫৮৩ মেগাওয়াট। সে অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় ছিল পাঁচ হাজার এক কোটি ২৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মেগাওয়াটের জন্য গড়ে এক কোটি ৪০ লাখ টাকা দরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছর সক্ষমতা সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৬৮৫ মেগাওয়াট। সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল পাঁচ হাজার ৪৯০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এতে গড়ে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ দাঁড়ায় এক কোটি ৪৯ লাখ টাকা।

২০১৩-১৪ অর্থবছর বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা চার হাজার মেগাওয়াট ছাড়ায়। সে অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল চার হাজার ৭১৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এতে গড় ব্যয় দাঁড়ায় এক কোটি ১৫ লাখ টাকা। ওই অর্থবছর আইপিপিগুলো উৎপাদন শুরু করে। বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ায় এগুলোর চুক্তির মেয়াদ ছিল গড়ে ১৫ বছর। ফলে ওই অর্থবছর থেকে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ হ্রাস পেতে শুরু করে।

২০১৪-১৫ অর্থবছর বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ৪৪৮ মেগাওয়াট। এজন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় চার হাজার ৬৬৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছর সক্ষমতা পাঁচ হাজার মেগাওয়াট ছাড়ায়। এর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল পাঁচ হাজার ৩৭৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছর বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা আরও বেড়ে হয় পাঁচ হাজার ৪৫৯ মেগাওয়াট। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পরিশোধ করা হয় পাঁচ হাজার ৭৬৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। তিন বছরই গড় ক্যাপাসিটি চার্জ প্রায় কাছাকাছি ছিল।

২০১৭-১৮ অর্থবছর কয়েকটি রেন্টাল কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ২১৩ মেগাওয়াট। এজন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় ছয় হাজার ২৪১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এতে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ কিছুটা বেড়ে হয় এক কোটি ২০ লাখ টাকা। পরের (২০১৮-১৯) অর্থবছর বেসরকারি খাতের সক্ষমতা আবার বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৭৪১ মেগাওয়াট। এজন্য সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় আট হাজার ৭২২ কোটি ২৭ লাখ টাকা। ডিজেলচালিত নতুন ছয়টি স্বল্পমেয়াদি আইপিপি যুক্ত হওয়ায় সে বছর ক্যাপাসিটি  চার্জ বেড়ে দাঁড়ায় এক কোটি ৫২ লাখ টাকা।

২০১৯-২০ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়ায় আট হাজার ৪১১ মেগাওয়াট। এজন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় ১০ হাজার ৮৫২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এতে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ দাঁড়ায় এক কোটি ২৯ লাখ টাকা। আর ২০২০-২১ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৭৩৪ মেগাওয়াট। এজন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় ১৩ হাজার ২১ কোটি তিন লাখ টাকা। এতে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ পড়ে এক কোটি ৩৪ লাখ টাকা। আর শেষ দুই বছর গড় ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল যথাক্রমে ২০২১-২২ অর্থবছর এক কোটি ২৭ লাখ টাকা ও ২০২২-২৩ অর্থবছর এক কোটি ৩৩ লাখ টাকা।