বিদায়ী অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণ বেড়ে ৯৯ বিলিয়ন ডলার

রোহান রাজিব: দেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েই যাচ্ছে। গত তিন মাসে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। এতে বাংলাদেশের বিদেশে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯৯ বিলিয়ন ডলার। গত তিন মাসে বেসরকারি-সরকারি উভয় খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। তবে বড় অংশই বেড়েছে সরকারি খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি ঋণ-সংক্রান্ত এক হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ শেষে দেশের সরকারি-বেসরকারি খাতে মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৫ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ তিন মাসে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। আর এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৩ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের জুন শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছর ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বিদেশি ঋণ বেড়েছিল মাত্র ৫২ কোটি ডলার।

২০২৩ সালের মার্চ শেষে দেশের বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। জুন শেষে এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ তিন মাসে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৭৫ দশমিক ৯৮ মিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বেসরকারি খাতের নেয়া বিদেশি ঋণের মধ্যে ৯ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার ট্রেড ক্রেডিট ঋণ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার হলো বায়ার্স ক্রেডিট। মূলধনি পণ্য ও সেবা আমদানির জন্য ব্যবসায়ীরা বিদেশি ব্যাংক থেকে এ ঋণ নিয়েছেন। ডেফার্ড পেমেন্ট বা দেরিতে পরিশোধের শর্তে ঋণের পরিমাণ ৯৬৯ মিলিয়ন ডলার এবং বিদেশি ব্যাক টু ব্যাক এলসি ঋণের স্থিতি ৮৪৬ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া সরাসরি স্বল্পমেয়াদি ঋণ হিসেবে বিদেশি ঋণের স্থিতি ৩ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের ঋণের পরিমাণ ২ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। আর বেসরকারি খাতের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর থেকে ডলার বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, যা এখনও কাটেনি। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশি ঋণ বাড়াতে বেশকিছু পরিকল্পনা করেছে। তার মধ্যে আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল), বিশ্বব্যাংক ও এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) থেকে ঋণ নেয়ার জন্য চুক্তি করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ বাড়াতে চেষ্টা করছে। তবে ডলারের বাজার এখনও অস্থির থাকার কারণে ব্যাংকগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো আগের ঋণ পরিশোধে বেশি মনোযোগী। তাই বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণ বাড়ছে না। আর বিদেশি ঋণের সুদহার বেশি হওয়ার কারণে উদ্যোক্তারাও ঋণ নিচ্ছেন না। তাই বেসরকারি খাতে বিদেশি নতুন ঋণ বাড়ছে না।

বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, বিদেশি ঋণের সুদহার অনেক বেড়ে গেছে। আগে যেখানে লাইবর এক শতাংশ ছিল, সেটা এখন বেড়ে পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ হয়ে গেছে। এতে উচ্চ সুদহারে উদ্যোক্তারা ঋণ আনতে চাচ্ছে না। তাই বিদেশি নতুন ঋণ আসছে না।

তিনি আরও বলেন, ডলারের এখনও অস্থিরতা কাটেনি। গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে ২৫ শতাংশ টাকার দরপতন হয়েছে। এ অস্থিরতার কারণে ব্যাংকগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এছাড়া দেশের রেটিং ও ব্যাংক খাতের আউটলুক নেগেটিভ হওয়ার কারণে বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে চাচ্ছে না। এর ফলে বেসরকারি খাতের নতুন ঋণ কম এসেছে।

অন্যদিকে গত তিন মাসে সরকারি খাতের ঋণের পরিমাণ ৩ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। গত মার্চ শেষে এ খাতের বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৭৩ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। এ ঋণের মধ্যে সরাসরি সরকারের ঋণ রয়েছে ৬৪ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার, যার পুরোটাই দীর্ঘমেয়াদি। বাকি ১১ দশমিক ১২ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত কয়েক বছরে বিদেশি ঋণ সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ছয় বছরেই এ ঋণ বেড়ে দুই দশমিক ১৯ গুণ হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ বাড়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে।

২০১৬-১৭ অর্থবছরের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। পরের অর্থবছর (২০১৭-১৮) তা ১০ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার বেড়ে ৫৬ দশমিক ০১ বিলিয়ন ডলার হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৬২ বিলিয়ন বেড়ে ৬২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন বেড়ে ৬৮ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন, ২০২০-২১ অর্থবছর ১২ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন বেড়ে ৮১ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন বেড়ে ৯৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাত্র ৩ দশমিক ৭১ বিলিয়ন বেড়ে ৯৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন দাঁড়ায়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা-পরবর্তী বছর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্থবিরতা ছিল। তখন বিদেশি ঋণের সুদহার অনেক কমে যায়। ওই সময়ে ডলারের চাহিদাও কমে। এতে অনেক দেশ তখন ঋণ পরিশোধ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটে উল্টোটি। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিসহায়তার মাধ্যমে ঋণের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়। ঋণ পরিশোধের শর্ত শিথিল করে। কম সুদ এবং সহজ শর্তের কারণে ব্যবসায়ীরাও বিদেশ থেকে প্রচুর ঋণ নিতে থাকেন। ফলে ২০২১ সালে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ বৃদ্ধি পায়।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, সরকার দ্রুত ঋণ নিয়ে বর্তমান সংকট মোকাবিলা করতে চাচ্ছে। তাই অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি যেকোনো উৎস থেকেই পাচ্ছে, সেখান থেকেই নিচ্ছে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও দুই বিলিয়ন ডলার নিতে পারে। তাই সরকারের ঋণ বাড়ছে। তবে বর্তমান সংকটে বিদেশি ঋণ দরকারও রয়েছে। কারণ রিজার্ভ ধরে রাখতে সরকারের কাছে এর বিকল্পও আপাতত নেই।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০