Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 2:42 am

বিদায় স্বৈরতন্ত্র: গতি ফিরুক গণতন্ত্রের

মোহাম্মদ আবু নোমান: বাংলাদেশ তো আন্দোলন, সংগ্রাম, লড়াই, বিপ্লব, বিদ্রোহের দেশ। এ দেশের মানুষ আন্দোলন, সংগ্রামের মাধ্যমেই নিকট অতীতে ব্রিটিশ, ভাষা আন্দোলন ও পাকিস্তান ভাগ ছাড়াও কোনো দেশীয় স্বৈরতন্ত্রকেও স্থায়ী আসন গড়তে দেয়নি। এবারের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ইতিহাসের এ সত্যেরই পুনরাবৃত্তি ঘটল। ইতিহাসের এ বিষয়টি আওয়ামী শাসক দলের নেতাদের জানা ছিল না এমন নয়; বরং অতীতে তাদেরই আন্দোলনের মুখে গণআকাক্সক্ষার বিপরীতে দাঁড়ানো অনেক শাসক বিতাড়িত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ অতীত হতে শিক্ষা গ্রহণ করেনি। নেতাদের মানসিকতা ছিল, ‘নৌকা মার্কা পেলেই চলবে, ভোট লাগবে না। ভোটে জিততে ভোটার লাগে না। দরকার টাকা, ক্যাডার আর আমলা-পুলিশের।’

পৃথিবীর ইতিহাসে কেউ নিজ কর্মফল এড়াতে পারেনি। ফলে আজকের হার্ডহেডেড পরিণাম আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বকে ভোগ করতে হচ্ছে। তবে বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে যারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবেন, তারাও বর্তমানের শিক্ষাটি গ্রহণ করবেন না! অপেক্ষা : ‘আবারও আমাদের হোঁচট খেতে হবে, সেদিন বেশি দূরে নয়!’
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ৮৪ বছর বয়সি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে ৮ আগস্ট বঙ্গভবনে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১৪ জন শপথ নিয়েছেন। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখার অধীর অপেক্ষায় আমরা। এ জন্য দরকার আমাদের পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা ও কাঠামোর পরিবর্তন। পৃথিবীর অন্য দেশের গণতান্ত্রিক ধারা ও নির্বাচনী কাঠামো দেখা আমাদের দরকার নেই। কারণ অন্য দেশের মানুষের চরিত্র, দায়িত্ব, দায়বদ্ধতা ও দেশপ্রেম আর বাংলাদেশের মানুষের চরিত্র, নৈতিকতা ও সামষ্টিক বৈশিষ্ট্য এক নয়। এজন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্বাচন আয়োজনে একটু বেশি সময় লাগলেও নিতে হবে।
অরাজনৈতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কখনো ভেবেছেন কি তারা দেশের উপদেষ্টা হবেন? তারাতো কোটা সংস্কারের দাবি ছাড়া বড় কোনো প্রত্যাশা নিয়ে আন্দোলন শুরু করেননি। কিন্তু আওয়ামী লীগের ড্যাম কেয়ার ও দাম্ভিকতার কারণে নানা ঘটনার ঘনঘটা আন্দোলনকে নিয়ে যায় নতুন মাত্রায়। একটি সাধারণ দাবি-দাওয়ার আন্দোলন অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান, অকল্পনীয় বিপ্লবে পরিণত হয়, যাতে ঘটে প্রতাপশালী সরকারের পতন। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো ছিল যৌক্তিক, যেহেতু তারা কোটাপদ্ধতির সংস্কার চেয়েছে, বিলুপ্তি নয়; দাবিগুলো মেটানো সম্ভব ছিল। কিন্তু শুরু থেকেই যেভাবে শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ বিবেচনা করে পুলিশ দিয়ে শক্তি প্রয়োগ করে আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে তাদের বিক্ষোভের মাত্রাটিই শুধু বেড়েছে।

গত প্রায় ১৬ বছর সরকারকে নিরাপদে রাখতে এবং নির্বাচনী গণতন্ত্র নষ্ট করতে দেশের কতিপয় দৈনিক ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম এবং আমলাদের সুবিধাবাদী অংশ বড় ভূমিকা রেখেছিল। ইন্টারচেঞ্জে এসব গণমাধ্যম ও আমলাতন্ত্র সুবিধাভোগী গোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ পথ ধরেই আমলাতন্ত্র দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো এসব প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে নিজের ভোল পাল্টিয়ে শেখ হাসিনাকে ‘স্বৈরাচারী’ ও ‘মাদার অব মাফিয়া’, ‘দুর্নীতির রানী’ বলেও অভিহিত করছে। রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিকদের দুর্নীতির দৃষ্টান্ত লিখতে গেলে বড় এক কিতাব হয়ে যাবে। তবে সাম্প্রতিক উদাহরণ বেনজীর-মতিউরদের লুটপাটের কেচ্ছাকাহিনি। স্বয়ং শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তার একজন পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক।

দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী দল, শিক্ষার্থী এবং সবরকম আন্দোলন যা-ই ঘটুক না কেন; সবকিছুকে দমানোর জন্য ক্ষমতাসীনরা পুলিশকে ব্যবহার করেছে। যার কারণে জনগণ-পুলিশ সাংঘর্ষিক অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল। পাশাপাশি পুলিশের চাঁদাবাজি, নানা হয়রানি, বলপ্রয়োগ এবং দুর্নীতিও বেশিরভাগ সময় আলোচিত হওয়ায় পুলিশবিরোধী অবস্থান ছিল অনেকটাই তীব্র। থানাগুলোতে সত্যিকারের সেবকদের বসানো হয়নি। কথিত সেবার জঞ্জাল ও ডায়ালগে আবদ্ধ আমরা। সত্যিকার সেবা কোথায়? চিকিৎসায় সেবা, থানায় সেবা, পরিবহনে সেবা, ট্রাফিকে সেবা! এতো ‘সেবা’ আমরা আর নিতে পারছি না। পুলিশ কোনো রাজনৈতিক দলের ভাড়া খাটবে না; দলের মাস্তান হিসেবে কাজ করবে না।

যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণকে নিরাপত্তা দেবে, অবৈধ বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, সেখানে তারাই অবৈধ আটক, অপহরণ, গুম, খুনের মতো অপরাধ নির্বিচারে করে গেছে। পুলিশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী না হয়ে দলীয় কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছে, শুধু একটি নির্দিষ্ট সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে। আমরা বলতে চাই আওয়ামী লীগ পুলিশ অথবা বিএনপি পুলিশ নয়, হতে হবে সত্যিকার ‘বাংলাদেশ পুলিশ’। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সেনাপ্রধান যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেখানে বলেছিলেন, তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু আমরা দেখলাম অন্য চিত্র। এমন মোমেন্টে প্রথমই হলো নিরাপত্তা। কিন্তু নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। দেশের প্রায় সব জেলাতে সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়েছে, মন্দির ভাঙা, দোকানপাট, ঘরবাড়ি একেবারেই বাধাহীনভাবে লুটপাট হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান গণভবনে, সংসদ ভবন, ফ্রী-স্টাইলে কীভাবে লুটপাট হলো? দেশের ৪০০ থানা ভবনের আসবাবপত্র, অস্ত্র, গোলাবারুদ আগুনে পুড়েছে।

সেনাবাহিনী কেনো থাকলো না। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সেখানে অবস্থান নিয়ে কেন উত্তেজিত জনতাকে ফিরিয়ে দিল না। বাংলাদেশে এর আগেও তো গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। তখন তো এমন পরিস্থিতি হয়নি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর পোড়ানো হয়েছে; ব্যক্তিগত অনেক বাসা, কারখানা, ফ্যাক্টরিতে লুটপাট, ভাঙচুর হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি কারও পছন্দ নাও হতে পারে; কিন্তু বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের কী দোষ?
আন্দোলনের সময় সাইনবোর্ডে পাচপোর্ট অফিস ও মেট্টোরেলে আগুন দেয়া হয়েছিল। শতশত সরকারি গাড়ি পোড়ানো হলো। এসব প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি বিশেষের নয়, রাষ্ট্রীয় সম্পদ। হামলা, অগ্নিকাণ্ড, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় বহির্বিশ্বে ক্ষুণ্ন হবে দেশের ভাবমূর্তি। স্মরণে রাখতে হবে, চলমান পরিস্থিতির দিকে যেমন দেশের মানুষ তাকিয়ে রয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক মহলও বাংলাদেশের পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পরিসরেও দেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

গণমানুষের দল আওয়ামী লীগ এতোটা গণবিচ্ছিন্ন হলো কীভাবে? দেশের অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে দলীয় নেতা-নেত্রীরা এ জিকিরেই মশগুল ছিলেন। তারা কখনো সাধারণ মানুষের পালস ও নিত্যদিনের কষ্ট বোঝার চেষ্টা করেননি। রাষ্ট্রের সেবায় না হলেও রাষ্ট্রশাসন ও রাষ্ট্র উন্নয়নে সফল ছিলেন শেখ হাসিনা। নজিরবিহীন উন্নয়ন করলেও মানুষ তার প্রাত্যহিক দৈনন্দিন জীবনের কষ্ট বা আনন্দটিকেই বেশি মনে রাখে। সুতরাং পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, ফ্লাইওভার নির্মাণ, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন করার পরও মানুষ যখন বাজারে গিয়ে সংসারের হিসাব মেলাতে পারে না, তখন তার কাছে এসব উন্নয়ন বোগাজ মনে হয়। এসব বিষয় মাথায় রাখেনি আওয়ামী লীগ সরকার।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চোখ ধাঁধানো অভাবনীয় উন্নয়ন করেছেন, তা কেউ অস্বীকার করবে না। এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতিতে চারপাশ ছেয়েছিল এটাও সিকরেটের কিছু নেই। আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী বড় দলের এমন হোঁচট খাওয়ার [কর্মের] দায়, খোদ আওয়ামী লীগও অস্বীকার করবে না।
বর্তমানে দেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচকের অবস্থাই লম্বা সময় ধরে নাজুক। হোঁচট খেয়েছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এই অবস্থায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অর্থনীতিতে দ্রুত গতিশীলতা আনার আহ্বান করছি আমরা। রপ্তানি কার্যক্রম সংকুচিত হওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া ঝুঁকিতে থাকা ব্যাংক খাতের দুর্বল অবস্থা ও অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে অর্থনীতিকে গতিশীল করা চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা সক্ষম হবে এটাই চিন্তার। নতুন সরকারের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দরকার শক্তিশালী টিম। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন টিম যথেষ্ট কিনা ভাবতে হবে।
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত অর্থনীতি গতিশীল ও ঘুষ রোধ করা, স্থানীয় সরকার কাঠামোয় পরিবর্তন, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ পুনরুদ্ধারে কৌশল অবলম্বন এবং সেবা পাওয়ার সময় কমাতে হবে। দেশের ঘুনেধরা প্রশাসনে এটা মোটেই সহজ নয়? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আরও অভিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন নয় কী? কারণ নীতিগত ও কাঠামোগত অনেক সংস্কার করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের অবস্থা ভালো নয়। রাজস্ব আয় বাড়াতে ব্যাপক সংস্কার ও কৌশলগত পর্যালোচনার মাধ্যমে কাস্টমসের সংস্কার করতে হবে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের মাধ্যমে দেশকে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার কাজে নতুন সরকার সফল হবে, এটাই কামনা। মনে রাখতে হবে, দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসন ও বারবার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ থেকেই ছাত্র ও জনতা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে শেখ হাসিনা সরকারকে বিদায় করেছে। ফলে গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনাই হবে মূল লক্ষ্য।