রেজাউল করিম খোকন : বাংলাদেশ এখন প্রতি বছর বিদেশি ঋণ পরিশোধে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করছে, তার জন্য নতুন ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আদায় করা রাজস্ব ব্যবহার করে যাবতীয় পরিচালন খরচ মেটানো হচ্ছে এখন। রাজস্ব বাজেট থেকে ঋণের সুদ-আসলের পুরো অর্থের জোগান দেয়া যাচ্ছে না। ফলে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। রাশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন উৎস থেকে বড় প্রকল্পে কঠিন শর্তের ঋণ নেয়া হচ্ছে। ওই সব ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়ও এসে গেছে। এতে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। গত তিন অর্থবছরের বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারকে ২৪ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা ঋণ করতে হয়েছে। চলতি অর্থবছরেও প্রায় ১৫ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা ঋণ করতে হবে। বাজেটের দলিলে শুধু সুদ খরচের বরাদ্দ দেখানো হয়। বিদেশি ঋণের আসলের বড় অংশ ঋণ করে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আদায়ের বিকল্প নেই। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জিডিপির তুলনায় সাড়ে ১৫ শতাংশ বিদেশি ঋণ নেয়া হয়েছে। প্রতি বছরই এই অনুপাত বেড়েছে। সর্বশেষ গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২১ দশমিক ৮০ শতাংশে। গত ডিসেম্বর মাস শেষে সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ৩৪ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ সরকারি ঋণ এবং ২০ শতাংশের মতো বেসরকারি খাতের ঋণ। গত অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের পুঞ্জীভূত পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৭৬ কোটি ডলার, যা আগের এক যুগের মধ্যে তিন গুণ বেড়েছে। অন্যদিকে গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৭০ কোটি ডলার শোধ করতে হয়েছে। শুধু এক বছরের ব্যবধানেই এই ঋণ পরিশোধ ১১০ কোটি ডলার বেড়েছে। এমন অবস্থায় সরকার চলতি অর্থবছরেই দাতাদের কাছ থেকে আরও ১ হাজার কোটি ডলার ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করছে। বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের উদাহরণ হিসেবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের বলা যায়, এই প্রকল্পের সুদ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে। এরই মধ্যে ৩৩ কোটি ডলার পরিশোধ হয়েছে। গ্রেস পিরিয়ড শেষে ২০২৬ সাল থেকে প্রতি বছর ৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। ঋণ করে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু এসব প্রকল্প রপ্তানি বাড়াতে পারছে কি না, তা দেখতে হবে। এসব প্রকল্পে আয় হচ্ছে টাকায়। ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে ডলারে। ডলারের দাম বাড়ার ফলে ঋণ পরিশোধে বেশি টাকাও খরচ হচ্ছে। এমনকি বেসরকারি খাতের ঋণ পরিশোধেও রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কাসহ আফ্রিকার দেশগুলোর চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। বিদেশি ঋণ কেন নেব, কীভাবে আমরা বিদেশি ঋণ পরিশোধ করব, কীভাবে আমরা রপ্তানির সক্ষমতা বাড়াবÑতা নিয়ে বেশি চিন্তা করা উচিত। কারণ, রপ্তানি বাড়লে তা ঋণ পরিশোধকে সহজ করবে। এখন চিন্তা করা উচিত কীভাবে রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা করা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য একজন বিশেষ উপদেষ্টা আছেন, যার একটি বিশাল ব্যবসায় অভিজ্ঞতা আছে। তাকে দুর্নীতি এবং বিশেষ সুবিধাভোগীদের মোকাবিলা করতে হবে। ঋণ করে বড় প্রকল্প করলে ২০-৩০ শতাংশ খরচ বেড়ে যায়। এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি এবং ব্যবস্থাপনা বড় ইস্যু হয়ে যায়।
রাজস্ব বাজেট থেকে উন্নয়ন প্রকল্পে একটি টাকাও দেয়া যাচ্ছে না। ঋণ নিয়ে এত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে এর প্রতিফলন নেই। এত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ এখনও ২৩ শতাংশে আছে। বরং সরকারের হিসাবে, জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে। মানুষের গড় আয়ু কমেছে, মৃত্যুহার বেড়েছে। আবার বেকারের সংখ্যাও বেড়েছে। ২৫ শতাংশ পরিবারকে ঋণ করে চলতে হয়। গত দেড় দশকে এত কিছু করা হলো; তাহলে মানুষ এসবের সুফল পাচ্ছে না কেন? উল্টো আমরা কী দেখছি, ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয়া হয় না। শেয়ারবাজারের মাধ্যমে মধ্যবিত্তের টাকা লুটপাট হয়েছে। বৈদেশিক ঋণে মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পুঁজি সঞ্চয়ের নতুন উৎস হিসেবে উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতে তা বেশি হয়েছে। মেগা প্রকল্পের সঙ্গে ওই বিশেষ গোষ্ঠীর টাকা পাচারের সংশ্লেষ রয়েছে ।
বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ প্রথমবারের মতো ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। গত ডিসেম্বরের শেষে সরকার ও বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণে স্থিতি ছিল ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ৬৪ কোটি ডলার। যা দেশীয় মুদ্রায় ১১ ট্রিলিয়ন বা ১১ লাখ ৭ হাজার ৪০ কোটি টাকার সমান (প্রতি ডলার=১১০ টাকা ধরে)। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৬৫২ কোটি ডলার। সেই হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৪১২ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এমনই তথ্যই উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার। তার মানে পরের তিন মাসে ৪ বিলিয়ন বা ৪০৯ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ বেড়েছে। এই সময়ে সরকার ৪৪২ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ নিয়েছে। তার বিপরীতে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি কমেছে ৬৪ কোটি ডলারের। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৪ হাজার ১১৭ কোটি ডলার। আর গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে তা ৯ হাজার ৮১১ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। অর্থাৎ গত আট বছরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। গত ডিসেম্বর শেষে সেটি আরও বেড়েছে। জনশুমারি ও গৃহগণনা শুমারির চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। সেই হিসাবে গত ডিসেম্বরের শেষে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৯২ ডলার (প্রায় ৬৫ হাজার টাকা)। যদিও গত জুনের হিসাবে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ ছিল ৫৭৪ ডলার। আট বছর আগে এটা ছিল ২৫৭ ডলারের কিছু বেশি।মোট বিদেশি ঋণের মধ্যে সরকারি খাতে ৭৯ শতাংশ আর বেসরকারি খাতে ২১ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৭ হাজার ৯৬৯ কোটি ডলার। তার আগের তিন মাসে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৭ হাজার ৫২৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত বছরের শেষ তিন মাসে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অন্যদিকে গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ২ হাজার ৯৫ কোটি ডলার, যা গত সেপ্টেম্বরে ছিল ২ হাজার ১২৮ কোটি ডলার।
সরকার বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো সংস্থা এবং জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ নেয়। এ সব ঋণ নেয়া হয় মূলত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাজেট সহায়তা হিসেবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণদানে শীর্ষ দেশ ও সংস্থার মধ্যে ছিল বিশ্বব্যাংক, জাপান, এডিবি ও চীন। সাম্প্রতিককালে চীনা ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিদেশি অর্থায়নে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, মেট্রোরেল (লাইন-৬), হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ ইত্যাদি। ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার হলেও সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ জিডিপির অনুপাতে এখনও মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে আছে। এ অবস্থায় বিদেশি ঋণের কারণে অর্থনীতি দুর্দশাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের দেয়া প্রতিশ্রুতির ৪ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার পাইপলাইনে তথা অলস পড়ে আছে। অর্থাৎ দাতাদের বরাদ্দ করা এই অর্থ এখনও ছাড় হয়নি, যা দেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ সক্ষমতার অভাবে বিদেশি সহায়তার অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারে না। আবার দাতাদের দিক থেকেও কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অর্থ ছাড় করা যাচ্ছে না। অনেক দিন ধরে চলমান ডলার-সংকট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত কমে যাওয়ার এই সময় দাতাদের প্রতিশ্রুতির অর্থ ছাড় করাতে পারলে কিছুটা স্বস্তি মিলত। বিভিন্ন সময় নানা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য দাতাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ অর্থসহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল। কিন্তু সব অর্থ ছাড় করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত দাতারা যে পরিমাণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার তিন ভাগের এক ভাগও ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এর দ্বিগুণ হলো (৫ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা) পাইপলাইনে থাকা বিদেশি সহায়তার পরিমাণ। অর্থাৎ পাইপলাইনে থাকা অর্থ দিয়ে দুই অর্থবছরের জন্য দুটি এডিপি করা যায়। মেট্রোরেল নির্মাণ করতে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সে হিসাবে পাইপলাইনের অর্থ দিয়ে ১৫টি মেট্রোরেল তৈরি করা সম্ভব। আরও সহজ করে বলা যায়, বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুতের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার কোটি ডলার। অথচ দাতাদের কাছে পড়ে আছে এর দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ (৪ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার)। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, বাংলাদেশের অভাব শুধু অর্থ ছাড় করার চেষ্টা ও ইচ্ছায়। এ রকম অবস্থায় পাইপলাইনে থাকা বিদেশি প্রতিশ্রুতির অর্থ দ্রুত ছাড় করতে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করেছে সরকার। এমন কমিটি এর আগেও হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। বিভিন্ন প্রকল্পে বিদেশি সহায়তা থাকলেও তা নানা কারণে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে যত দিন যাচ্ছে, পাইপলাইন ততই বড় হচ্ছে।
ডলার-সংকট ও রিজার্ভ পরিস্থিতিÑএসব বিবেচনায় ডলারের প্রয়োজন মেটাতে দ্রুত বিদেশি সহায়তা ছাড় করার নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দাতাদেশ ও সংস্থা অনুদান ও ঋণ মিলিয়ে বাংলাদেশকে মোট ১৮ হাজার ৭৬৪ কোটি ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা বর্তমান বাজারমূল্যে দেশি মুদ্রায় ২০ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার মতো। এর প্রায় ৩২ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ এখনও ব্যবহার করতে পারেনি বাংলাদেশ। বিদেশি সহায়তা ব্যবহার না করতে না পারার হার ক্রমেই বাড়ছে। ৮ বছর আগে ২০১৬ সালে এই হার ছিল ২৯ শতাংশ। গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সব মিলিয়ে বাংলাদেশ বিদেশি সাহায্য ব্যবহার করতে পেরেছে ১২ হাজার ৬৮৭ কোটি ডলার। এ ছাড়া দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কারণে ১ হাজার ৪২২ কোটি ডলার প্রতিশ্রুতি বাতিল করেছে দাতা সংস্থা ও দেশগুলো। বাকি ৪ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার এখন পাইপলাইনে পড়ে আছে, যা বাংলাদেশ চাইলে ব্যবহার করতে পারে। প্রকল্প বাস্তবায়নে যেমন সমস্যা আছে, তেমনি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে দাতাদের নানা শর্ত ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে মন্ত্রণালয়গুলো বিদেশি সহায়তার প্রকল্পে কম আগ্রহ দেখান। তবে কয়েক বছর ধরে বিদেশি সহায়তার অর্থ ছাড় কয়েক গুণ বেড়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী হলো বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান। এই তিন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছেই পড়ে আছে পাইপলাইনের প্রায় অর্ধেক অর্থ, যা পরিমাণে ২ হাজার ১৮২ কোটি ডলার। এর মধ্যে জাপানের কাছে সর্বোচ্চ ৮৪৫ কোটি ডলার পড়ে আছে। বিশ্বব্যাংক ও এডিবিতে পড়ে রয়েছে যথাক্রমে ৭৬৬ কোটি ও ৫৭১ কোটি ডলার। চীন আর ভারতের কাছ থেকেও বড় অঙ্কের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি সহায়তার ধরনও পাল্টেছে, বদলেছে প্রতিশ্রুতিও। স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক বছর দাতারা যে সাহায্য দিত, তার মধ্যে প্রকল্প সহায়তা ছিল গড়ে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ। বাকি সহায়তা আসত খাদ্য ও পণ্য সাহায্য বাবদ। কয়েক দশকের ব্যবধানে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। এখন বিদেশি সহায়তার প্রায় শতভাগই আসে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে। বিদেশি ঋণের প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন ও বিদেশি সহায়তা ছাড় ত্বরান্বিত করতে গঠিত কমিটির প্রথম বৈঠকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে সাত ধরনের সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো প্রকল্পের সময় বৃদ্ধি; প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি; দরপত্রের প্রতিটি ধাপে বাধ্যতামূলকভাবে ঋণদাতার অনুমোদন নেয়া; প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও দাতাদের মধ্যে কাজের সমন্বয়হীনতা; বারবার প্রকল্প সংশোধন; সম্ভাব্যতা যাচাই ও সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প নেয়া এবং প্রশিক্ষণের অভাবে বিদেশি অর্থ ব্যবহারে কর্মকর্তাদের অনভিজ্ঞতা। প্রতিশ্রুতির ঋণসহায়তা ছাড়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। পাইপলাইনে থাকা অর্থের একটি অংশ বাজেট সহায়তা হিসেবে স্থানান্তর করে ছাড় করা যেতে পারে। এছাড়া বিদেশি সহায়তা ব্যবহার করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, এমন মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য প্রতি মাসে অগ্রগতি প্রতিবেদন দেয়া বাধ্যতামূলক করা যায়। পুরো বিষয়টিকে তদারকি ও জবাবদিহির আওতায় আনতে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা উচিত। এছাড়া উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করে সব ধরনের সমস্যার সমাধান করে বিদেশি সহায়তার অর্থ দ্রুত ছাড় করতে হবে। আইএমএফের ঋণ নেয়া হয়েছে মূলত স্বস্তির জন্য। আমাদের আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও অন্যান্য সরবরাহকারী ঋণ এড়িয়ে চলা উচিত। বিদেশি ঋণ নেয়ার আগে যাচাই-বাছাই করা উচিত। আইএমএফ টাকা দিলেই নিয়ে নিতে হবে কেন? আমাদের এই ঋণ নেয়া আত্মঘাতী হয়ে ওঠে অনেক সময়। ঋণ নেয়ার আগে দর-কষাকষি করতে হবে। বিদেশি ঋণ কোন প্রকল্পে খরচ হচ্ছে, কীভাবে খরচ হচ্ছেÑএসব বিষয় বিবেচনা করা উচিত।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক