খেয়াল করার মতো বিষয়, ২০১৬ সালে স্থানীয় পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মোট লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৮ হাজার ৭৭৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৫ হাজার ৫৭ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছিলেন বিদেশিরা। একই সময় ৩ হাজার ৭১৬ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেন তারা। এ হিসাবে উল্লিখিত বছরে নিট বৈদেশিক বিনিয়োগ হয় ১ হাজার ৩৪০ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা ২০১৫ সালের তুলনায় অন্তত ১ হাজার ৩০৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা বেশি। বলা দরকার, ওই সময় নিট বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে ৯৫৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে বিদেশিরা কেন আমাদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়েছিলেন, তা অনুমানের অযোগ্য ঘটনা নয়। ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতা থেকে গতিময়তার দিকে অগ্রসর হওয়া বাংলাদেশের মতো একটি সম্ভাবনাময় বাজারের ব্যাপারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে গত মাসের শেষার্ধে বিশেষত মুদ্রানীতি ঘোষণার পর বাজারে যেভাবে দরপতন ঘটে, তাতে অনেকের শঙ্কা জন্ম ছিল বিদেশিরা বুঝি আগ্রহ হারাবেন। তবে উদ্বেগটা যে বাস্তবে পরিণত হয়নি, তার প্রমাণ দিচ্ছে গতকালের শেয়ার বিজে প্রকাশিত একটি খবর। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ‘জানুয়ারিতে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে’। বিস্তারিত খবরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে আমাদের প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, জানুয়ারিতে বিদেশিদের পোর্টফোলিওতে লেনদেন হয় আনুমানিক ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকার শেয়ার যার মধ্যে বিদেশিরা কিনেছেন বেশি, বিক্রি করেছেন কম। এক্ষেত্রে কেনা হয় প্রায় ৬১১ কোটি টাকার শেয়ার, যেখানে বিক্রি ৪২৫ কোটি টাকার শেয়ারের। আমাদের পুঁজিবাজারের ওপর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অটুট থাকার অর্থ হলো, তাতে স্থানীয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থাও ধীরে ধীরে ফিরবে। ফলে আমরা প্রত্যাশা রাখতে পারি, পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক দরপতন দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
এখন প্রশ্ন হলো, স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা কী দেখে ভয় পেলেন আর কেনইবা পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলভাবে বাড়ছে বিদেশি বিনিয়োগ? কারও কারও মতে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সাধারণত বিনিয়োগ করেন বাজারের দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ দেখে। বাজার ভালোমতো বিশ্লেষণ না করে, নিছক গুজবনির্ভর খবরের ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন না তারা। আমরা আশা করতে পারি, এবারেও আমাদের পুঁজিবাজারে তাদের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত বুদ্ধিদীপ্তই ছিল; নিরাবেগ বাজার মূল্যায়নের পরই গৃহীত হয়েছে সিদ্ধান্তগুলো। স্থানীয় বিনিয়োগকারীদেরও এ দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ দর্শন অনুসরণ করা উচিত বলে আমরা মনে করি। চরম বেয়ার মার্কেটের পরও বাজার থেকে ফাটকা উপাদানগুলো পুরোপুরি নির্মূল হয়ে গেছে, এমন প্রত্যাশা অমূলক বলেই বিবেচিত হবে। ফলে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাদের আচরণ আরও বুদ্ধিদীপ্ত হওয়া উচিত। পুরোনো ও ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা নিঃসন্দেহে চাইবেন চলতি বাজার থেকে আগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে। এটা অনৈতিক বা অনাকাক্সিক্ষত নয়। নতুন বিনিয়োগকারীরাও নিশ্চয়ই চান না বাজারে এসেই লোকসানের ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত হতে। কিন্তু দুপক্ষই যদি ক্ষতিপূরণ বা তাৎক্ষণিক মুনাফার আশায় অতি-তৎপর হয়ে ওঠেন, নিয়ন্ত্রণকারীর পক্ষে তা সামাল দেওয়া মুশকিল। লক্ষণীয়, আমাদের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা সীমিত। তবু ওই সম্ভাব্যতার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার গভীরভাবে কাম্য। তাতে স্থানীয় পুঁজির গুণগত উন্নয়ন ঘটবে বলেই ধারণা। তবে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে সঠিক পথে পরিচালনার প্রধান দায়িত্ব স্থানীয়দেরই সাধারণ বিনিয়োগকারী, তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থা, প্রত্যেকের। এ তিন উপাদানের কোথাও নির্দিষ্ট ভূমিকা পালনে গাফিলতি রয়ে গেলে শুধু বিদেশি বিনিয়োগ দিয়ে বাজারের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব।
Add Comment