বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়লেও বড় অংশই বসে থাকছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে প্রচুর আয় করেছে বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলো। সাম্প্রতিক বিদ্যুৎ খাতের সংকটে নতুন করে আলোচনায় আসে ক্যাপাসিটি চার্জ। তাই গত এক যুগে এ খাতে সরকারের ব্যয় ও কোম্পানিগুলোর আয় নিয়ে অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে তৃতীয় পর্ব
ইসমাইল আলী: বিদ্যুৎ খাতে গত ১২ বছরে দেশীয় কোম্পানির পাশাপাশি কিছু বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। তবে এর আগেও বাংলাদেশে কয়েকটি বিদেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল। আবার কয়েকটির চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে বিদেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৩৬৭ মেগাওয়াট। আর বিদেশি কেন্দ্রগুলোর জন্য ১২ বছরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা।
সংস্থাটির হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০-১১ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১২ বছরে পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ৮৬ হাজার ৬৬৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গেছে এ খাতে ব্যয়ের ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশ অর্থ।
পিডিবির তথ্যমতে, ২০১০-১১ অর্থবছর বাংলাদেশে ছয়টি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল। যুক্তরাজ্যভিত্তিক এ কোম্পানিটির কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা সে সময় ছিল ৩৯০ মেগাওয়াট। পরে তারা আরও কয়েকটি কেন্দ্র স্থাপন করে। এতে উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮০ মেগাওয়াট। তবে ধীরে ধীরে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া ও নবায়ন না করায় বর্তমানে এগ্রিকোর তিনটি কেন্দ্র রয়েছে বাংলাদেশে।
এতে বাংলাদেশে কোম্পানিটির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কমে দাঁড়িয়েছে ২৯৫ মেগাওয়াট। আর ২০১০-১১ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১২ বছরে সব মিলিয়ে কোম্পানিটির জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে সাত হাজার ৫৭৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, যা এ খাতে ব্যয়ের আট দশমিক ৭৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ থেকে এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল ক্রমশ ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে বলে জানান পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ খাতে খুবই সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে এগ্রিকো। তাদের কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতাও ভালো। তবে অন্যান্য দেশি কোম্পানির চুক্তি বারবার নবায়ন করা হলেও এগ্রিকোর কেন্দ্রগুলোর চুক্তি বাড়ানো হয়নি। এছাড়া দেশীয় অন্যান্য কোম্পানির চেয়েও সুযোগ কম পাচ্ছে কোম্পানিটি। তাই ধীরে ধীরে তারা ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ থেকে।
বিদেশি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সক্ষমতা মালয়েশিয়াভিত্তিক চীনা কোম্পানি এরডা পাওয়ার হোল্ডিংসের। কোম্পানিটির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বর্তমানে ৮১০ মেগাওয়াট। এ কোম্পানির দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে বাংলাদেশেÑএকটি মেঘনাঘাটে ও অপরটি হরিপুরে।
২০০২ সালে গ্যাসচালিত ৪৫০ মেগাওয়াট মেঘনাঘাট কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়। ১২ বছরে পিডিবিকে এ কেন্দ্রটির জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে চার হাজার ৩৭৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা। তবে এর আগে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে হরিপুর ৩৬০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্টটি। ১২ বছরে এ কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে দুই হাজার ৪১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। দুই প্ল্যান্ট মিলিয়ে ১২ বছরে এরডা পাওয়ার হোল্ডিংস ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে ছয় হাজার ৪১৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, যা এ খাতে ব্যয়ের সাত দশমিক ৪১ শতাংশ।
এদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর বাংলাদেশে ৩০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের এপিআর এনার্জি। ডিজেলচালিত এ কেন্দ্রটির জন্য চার বছরেই পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে দুই হাজার ৮৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা। যদিও প্রায় সময়ই এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বসে থাকে। এতে নামমাত্র উৎপাদন করা হয়। ফলে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি পড়ে।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক সেম্বকর্পও ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৪১৪ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে বাংলাদেশে। গ্যাসচালিত এ কেন্দ্রটির জন্য চার বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে দুই হাজার ৫৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা। সিরাজগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ৭১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সেম্বকর্পের হাতে। বাকি ২৯ শতাংশের মালিকানা বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির কাছে রয়েছে।
পিডিবির তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ সালে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ কোম্পানি লক্ষধনভি। এর আগে (২০১৩-১৪ অর্থবছর) লক্ষধনভির সহযোগী রাজলঙ্কা পাওয়ার বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে। দুইটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতাই ৫২ মেগাওয়াটের। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছর লক্ষধনভির সহযোগী আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে। ফেনীলঙ্কা নামে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদন সক্ষমতা ১১৪ মেগাওয়াট। তিন কেন্দ্র মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে লক্ষধনভির উৎপাদন সক্ষমতা ২১৮ মেগাওয়াট। আর তিন কেন্দ্রের লক্ষধনভি ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে এক হাজার ৪০০ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
যদিও বাংলাদেশে বেসরকারি তথা বিদেশি বিনিয়োগের প্রথম বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র হরিপুর বার্জমাউন্টেড পাওয়ার প্ল্যান্ট। ১৯৯৮ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিউ ইংল্যান্ড পাওয়ার কোম্পানি। এনইপিসি কনসোর্টিয়াম নামে প্রতিষ্ঠিত ২০ বছর মেয়াদি এ কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছর। এতে ২০১০-১১ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত ৯ বছরে কেন্দ্রটির জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে এক হাজার ১৯৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এর বাইরে ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষ দিকে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করেছে ভারতীয় নতুন বিদ্যুৎ কোম্পানি। দেশটির শাপুরজি পালনজি গ্রুপের এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য সে অর্থবছর কোনো ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়নি। তবে পুরোদ্যমে উৎপাদন শুরুর পর ২২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ কেন্দ্রটির জন্য বিদায়ী অর্থবছর পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে ৩২২ কোটি ৯ লাখ টাকা।