বিদেশেই বাড়ছে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগকৃত সম্পদ

জয়নাল আবেদিন: বিদেশ থেকে ঋণের পাশাপাশি বাংলাদেশিরাও বিনিয়োগ করছেন দেশের বাইরে। দিনের পর দিন এই বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে। আসল বিনিয়োগ ও মুনাফার সমন্বয়ে এর আকার বেড়েও চলেছে ক্রমান্বয়ে। ২০২১ সাল শেষে বৈদেশিক বিনিয়োগ গিয়ে ৩৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলারে পৌঁছেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ তিন হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা।

পাঁচ বছর আগেও (২০১৬) এ বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২১ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০টি ব্যাংক ও বেসরকারি কিছু কোম্পানির ওপর ভিত্তি করে বিদেশেই বাড়ছে বাংলাদেশিদের বৈধ বিনিয়োগ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে বিদেশে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলারে। এর মধ্যে কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ ছিল ২ কোটি ২৪ লাখ ও ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন ব্যাংক বিদেশে বিনিয়োগ করেছে ২০ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। ৫ কোটি ২৫ লাখ ডলার বিদেশেই উপার্জন করেছেন ব্যক্তি ও ব্যাংক খাতের উদ্যোক্তারা। এছাড়া মাদার কোম্পানি (বাংলাদেশি) থেকে ১১ কোটি ১৩ লাখ ডলার ঋণ নিয়েছে তারা। সবমিলিয়ে বাংলাদেশিদের বিদেশে বিনিয়োগ ৩৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলারে পৌঁছেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্য, হংকং, নেপাল, ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করছেন বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা। খাতভিত্তিক বিবেচনায় ফিন্যান্সিয়াল ইন্টারমিডিয়েটরিস, খনি ও খনন, ধাতু ও যন্ত্রপাতি পণ্য, ব্যবসা, রাসায়নিক ও ফার্মাসিউটিক্যালস খাত সবচেয়ে এগিয়ে আছে।

অন্যদিকে বৈধ লেনদেন ছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রা আদান-প্রদানকে কেন্দ্র করে সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্য অনুযায়ী,  এক বছরে অর্থপাচার বিষয়ক বা সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। তবে শুধু দুর্নীতি বাড়ার কারণে এমন লেনদেন বেড়েছে, তা নয়। সন্দেহজনক লেনদেন মনিটরিং জোরদার করা এবং এ কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তারা আরও বেশি সচেতন হওয়ায় এমন লেনদেনের চিত্র বেশি সামনে এসেছে।

গত ১৫ মার্চ বিএফআইইউয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনের (২০২০-২০২১) তথ্য অনুযায়ী, অবৈধভাবে যেসব অর্থ লেনদেন হয়েছে, তার বেশিরভাগই ব্যাংকিং মাধ্যমে। অন্যান্য মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের পরিমাণ খুবই কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট পাঁচ হাজার ২৮০টি সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে, যা তার আগের অর্থবছরে (২০১৯-২০২০) ছিল তিন হাজার ৬৭৫টি। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৪৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

বিনিয়োগের পাশাপাশি বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণও কম নয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ দেশে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২৩ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী, বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। কভিড মহামারির দুই বছরেই বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ যুক্ত হয়েছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। আর সর্বশেষ পাঁচ বছরে এ ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে টাকার বিপরীতে ডলার শক্তিশালী হওয়ায় বিদেশি ঋণের সুদ প্রায় ১২ থেকে ১৪ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। অন্যদিকে বর্তমানে দেশে ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশে বেঁধে দেয়া হয়েছে। ফলে যারা সস্তা উৎস হিসেবে বিদেশ থেকে নিয়েছিল, তারা এখন বিপাকে রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ১১ মাসের ব্যবধানে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এর সঙ্গে লন্ডন ইন্টার-ব্যাংক অফার্ড রেট (লাইবর) ও অন্যান্য পরিষেবা মিলে প্রায় ১৪ শতাংশ সার্ভিস চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণে বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে দেশি গ্রাহকদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৯ জুন ৯২ টাকা ৮৩ পয়সায় বিক্রি হয়েছে প্রতি ডলার। ২০২১ সালের ৩ আগস্ট প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। সুতরাং মাত্র ১১ মাসের ব্যবধানে ৮ টাকা ০৩ পয়সা বৃদ্ধি পেয়েছে ডলারের মূল্য। শতাংশীয় হিসাবে যা ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এভাবে ডলার শক্তিশালী হতে থাকায় বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন ঋণগ্রহীতারা।

সবকিছু ছাপিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের অলিখিত অবৈধ বিনিয়োগের পরিমাণও দিন দিন বাড়ছে। কারণ সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড় গড়ে উঠেছে। গত ১২ মাসে ব্যাংকটিতে বাংলাদেশিদের ৩ হাজার কোটি টাকা জমা হয়েছে। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক-এসএনবির ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০২১’ বার্ষিক প্রতিবেদন এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সুইস ব্যাংকে বর্তমানে বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণ ৮ হাজার ২৭৫ কোটি, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশিদের আমানত ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। প্রতি ফ্রাঁ বাংলাদেশি ৯৫ টাকা ৭০  পয়সা হিসেবে মোট টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৩৩ কোটি। ২০২০ সালে ব্যাংকটিতে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ, ২০১৯ সালে ৬০ কোটি ৩০ লাখ, ২০১৮ সালে ৬২ কোটি ও ২০১৭ সালে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০