বিদ্যমান গ্যাসের মজুত শেষ হয়ে যাবে ২০২৩ সালে

ইসমাইল আলী: দেশে গ্যাসের মজুতের সাড়ে ৫২ শতাংশ শেষ হয়ে গেছে। বিদ্যমান ২৬টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে সরবরাহ বাড়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। ১০ বছরে বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধানও মেলেনি। এতে ২০২৩ সালে বিদ্যমাস গ্যাসের মজুত শেষ হয়ে যাবে। যদিও এখনই রাজধানীসহ সারা দেশে আবাসিক ও শিল্প-কারখানায় বিদ্যমান গ্রাহকরা চাহিদা অনুপাতে গ্যাস পাচ্ছে না।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) স্টাডি অন এনার্জি সিকিউরিটি শীর্ষক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে সহায়তা করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউজকুপারস (পিডব্লিউসি)। এডিবির কারিগরি সহায়তার আওতায় এর চূড়ান্ত খসড়া প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সংস্থাটি।

এর তথ্যমতে, ২০১৫ সালে গ্যাসের মজুত ছিল প্রায় ১৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। ২০১৬ সালে তা কমে দাঁড়ায় সাড়ে ১১ টিসিএফ। ২০১৭ সাল শেষে তা আরও কমে দাঁড়াবে ১০ টিসিএফে। এরপর তিন বছর গড়ে দেড় টিসিএফ করে কমবে গ্যাসের মজুত। ২০১৮ সাল শেষে এ মজুত দাঁড়াবে সাড়ে ৮ টিসিএফ, ২০১৯ শেষে সাত ও ২০২০ শেষে ছয় টিসিএফ। এরপরের তিন বছর গড়ে প্রায় দুই টিসিএফ করে ব্যবহার হবে গ্যাস। এতে ২০২১ সাল শেষে মজুত দাঁড়াবে চার, ২০২২ সাল শেষে দুই ও ২০২৩ সালে তা শূন্যে পৌঁছাবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক দশকে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে সাড়ে ছয় শতাংশ হারে। অথচ এ সময়ে সরবরাহ বেড়েছে পাঁচ শতাংশ হারে। এতে গ্যাসের বিদ্যমান চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না। বর্তমানে গ্যাসের মজুত ও উৎপাদন অনুপাত ১০: ৭। নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে ও গ্যাসের উৎপাদন হার অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সালে মজুত শেষ যাবে। তবে সমুদ্রে গ্যাসের নতুন মজুত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও এক্ষেত্রে সাফল্য খুবই কম।

এদিকে দেশের গ্যাসের মজুত নিয়ে গত বছর সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে এক প্রতিবেদন উপস্থাপন করে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। এতে বলা হয়, দেশে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত ২৬টি গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসের মজুত নিরূপণ করা হয় ২৭ দশমিক ১২ টিসিএফ। এর মধ্যে ১৩ দশমিক ৬৩ টিসিএফ গ্যাস ব্যবহার হয়ে গেছে। অবশিষ্ট আছে ১৩ দশমিক ৪৯ টিসিএফ, যা দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে।

প্রতিবেদনে প্রতিটি ক্ষেত্রভিত্তিক মজুত, উত্তোলন ও অবশিষ্ট গ্যাসের পরিমাণ দেখানো হয়েছে। এতে দেখা যায়, ১৯৬২ সালে আবিষ্কৃত তিতাসের ক্ষেত্রটিতে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুত নিরূপণ করা হয়েছিল ছয় হাজার ৩৬৭ বিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে প্রায় চার হাজার ৪৬ বিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলন হয়ে গেছে। অবশিষ্ট মজুত রয়েছে দুই হাজার ৩২০ বিলিয়ন ঘনফুট। তিতাসের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গ্যাসের মজুত ছিল বিবিয়ানায় পাঁচ হাজার ৭৫৪ বিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে অবশিষ্ট আছে তিন হাজার ৩৮০ বিলিয়ন ঘনফুট। মজুতের দিক দিয়ে এর পরই রয়েছে কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্র। ক্ষেত্রটিতে মজুত রয়েছে দুই হাজার ৮৩ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এছাড়া রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাস মজুত রয়েছে এক হাজার ৮৭০ বিলিয়ন ঘনফুট। আর হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ ও ছাতকে ৪০০ বিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুত রয়েছে। ৩০০ বিলিয়ন ঘনফুটের বেশি মজুত রয়েছে শাহবাজপুর ও সেমুতাং গ্যাসক্ষেত্রে। বাকি ক্ষেত্রগুলোয় অল্প পরিমাণে উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুত রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির চার বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও পরিকল্পনাতেই সীমাবদ্ধ সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান। ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিরও দুই বছর পেরিয়ে গেছে। আবার স্থলভাগেও নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে উল্লেখ করার মতো কোনো সাফল্য নেই। কয়েক বছর ধরে পুরোনো ক্ষেত্রের পুনর্মূল্যায়নের মধ্যেই আটকে আছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম। উৎপাদন বাড়াতে তাই জোর দেওয়া হচ্ছে পুরোনো গ্যাসক্ষেত্রে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে গ্যাসের গড় উৎপাদন ছিল দৈনিক এক হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে তা দুই হাজার ৭৪০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়েছে। এ হিসাবে পাঁচ বছরে গ্যাস উৎপাদন দৈনিক প্রায় এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কূপ থেকে সক্ষমতার অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করা হলে ভূ-অভ্যন্তরে গ্যাসস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। গ্যাস উত্তোলনের স্বাভাবিক প্রবাহ এতে নষ্ট হয়। ফলে কমে যায় গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন মেয়াদ। নির্ধারিত সময়ের আগেই ক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত হওয়ার শঙ্কাও থাকে। বাড়তি উৎপাদনের কারণে গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত হওয়ার উদাহরণ সমুদ্রবক্ষের একমাত্র উৎপাদনকারী ক্ষেত্র সাঙ্গু।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, গ্যাস খাতে নেওয়া সব পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয়েছে। গত কয়েক বছরে নতুন কোনো ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। বাপেক্স কিছু চেষ্টা চালালেও তা সফল হয়নি। ফলে পুরোনো ক্ষেত্র থেকে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর ওপরই জোর দিতে হচ্ছে। তবে চার-পাঁচ বছর পর গ্যাসের চাপ কমতে শুরু করবে। ফলে দৈনিক গ্যাস উৎপাদনও কমবে। তখন পুরোনো ক্ষেত্র দিয়ে আর স্বাভাবিক সরবরাহ ধরে রাখা যাবে না। তাই সমুদ্র ও স্থলভাগে দ্রুত নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারে এখনই জোর দিতে হবে।

এদিকে স্থলভাগ ও সমুদ্রসীমায় নতুন গ্যাস পাওয়া গেলেও তা ২০৪১ সালের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে বলে মনে করে পেট্রোবাংলা। গত মার্চে সংস্থাটির এক বৈঠকে উপস্থাপিত ‘ন্যাচারাল গ্যাস ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই সিনারিও অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়।

এতে বলা হয়, বর্তমানে দৈনিক গড়ে দুই হাজার ৮৫৮ মিলিয়ন আদর্শ ঘনফুট (এমএমএসসিএফডি) সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে বাপেক্সের পুরোনো ক্ষেত্রগুলোয় মিলছে দুই হাজার ৭৯৪ মিলিয়ন ঘনফুট। আর বাপেক্সের নতুন ক্ষেত্র থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৬৪ এমএমসিএফডি। আগামী বছর বাপেক্সের পুরোনো ও নতুন উভয় ধরনের ক্ষেত্র থেকে গ্যাস সরবরাহ কিছুটা বাড়বে। এতে মোট সরবরাহ তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ছাড়িয়ে যাবে। তবে এর পর থেকে বাপেক্সের পুরোনো ক্ষেত্রগুলোর গ্যাস সরবরাহ কমতে শুরু করবে। আর নতুন আবিষ্কৃত ক্ষেত্রগুলো থেকেও গ্যাসের উৎপাদন কমতে শুরু করবে ২০২৫-২৬ সালের পর। ২০৪০-৪১ অর্থবছরে সব ধরনের মজুত শেষ হবে যাবে।

জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ বলেন, ভবিষ্যতে গ্যাসের চাহিদা ও জোগান কী হবে, তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র জানা নেই। তবে কিছু সমীক্ষা আর প্রক্ষেপণের ভিত্তিতে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি নিরূপণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। আগামী বছর থেকে তা জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এতে গ্যাসের চাহিদা মোকাবিলা সহজ হবে।

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০