আমাদের মানুষ না হয়ে ওঠার পেছনে বড় কারণ আমরা নিজেরাই। আমাদের সত্যিকারের মানুষ হতে দেয় না আমাদের কলুষিত মন, কলুষিত আত্মা। সঠিক মানুষ না হয়ে ওঠার পেছনে আমাদের অনেক মেনে নেওয়া, সহ্য করা, যা হচ্ছে হোক ধরনের বোধগুলো দায়ী। প্রতিদিন হাজারটা অনিয়ম দেখে অনিয়মকেই নিয়ম মনে করছি আজকাল।
প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে কাজের বুয়ার সঙ্গে গিন্নির তর্ক-বিতর্ক দেখে শুরু হয় গৃহকর্তার দিন। গিন্নির হাতে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে প্রতিনিয়ত। অন্যায় যে হচ্ছে তা দেখছি, বুঝছি, শুনছি; কিন্তু তারপরও আমরা চুপ করে থাকছি। গিন্নির ‘ওরে মারলে তোমার কী’ ধরনের বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চান না কোনো গৃহকর্তা। তাই সয়ে যাচ্ছি, সব বুঝে-শুনে-নীরবে।
এমন একটি পরিবারে জš§ নেওয়া ছোট বাচ্চাটি এমনটা দেখেই বড় হচ্ছে। বাল্যকাল থেকে সে এ ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছেÑসমাজের নিচুস্তরের মানুষকে ইচ্ছা হলেই নির্যাতন করা যায়। ইচ্ছেমতো তার ওপর জোর খাটানো যায়, তাকে গালিগালাজ করলে কোনো প্রতিবাদ করবে না, প্রতিবাদ করলেও সেটা হয় মূল্যহীন। তারপর স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেলেও বাবার টাকার জোরে ভর্তি হওয়া যায় দেখে একদিন সে জেনে যায়, টাকা থাকলেই এখানে সব হয়। ‘বাবার পয়সা’ নিয়ে একধরনের অহমিকা চলে আসে তার মধ্যে। সমাজকে উচ্চবিত্ত-নি¤œবিত্ত এ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করে ফেলে সে অনায়াসেই। স্কুলের শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়লে ক্লাসে ভালো মার্ক পাওয়া যায়Ñএমন শিক্ষা নিয়ে শুরু হয় তার শিক্ষাজীবন। শিক্ষকদের আদর্শগত জায়গা থেকে দেওয়া শিক্ষার অভাব সে অনুভব করে পদে পদে। এতে করে একদিন তার জগৎটা হয়ে ওঠে আদর্শশূন্য। মানবিক গুণাবলি ও মূল্যবোধ থেকে সে দূরে সরে যেতে থাকে। এভাবেই একদিন মায়ের কোলে ‘ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি মোদের বাড়ী এসো’ শুনে ঘুমিয়ে পড়া শিশুটি, ‘মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই’ শুনে কাজলা দিদির জন্য মন খারাপ করা শিশুটি, কচ্ছপ আর খরগোশের গল্পকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গল্প মনে করা শিশুটি বয়সের ভারে অমানুষ হয়ে ওঠে।
কেন এমন হয়? এরা প্রত্যেকেই তো একদিন শিশু ছিল। অনুভূতিপ্রবণ একটা মন ছিল। মানুষকে ভালোবাসার চেষ্টা ছিল। সুলতান সুলেমানের গল্প শুনে ন্যায়বিচারক হওয়ার স্বপ্ন ছিল, শেখ সাদীর গল্প পড়ে শ্রেণিবৈষম্য না করার কথা ছিল। তার পরও সে কেন অমানুষ হয়ে ওঠে?
উত্তরটা খুঁজলে পাওয়া যায় সহজেই। একসময়ের অনুভূতিপ্রবণ শিশুটি ‘চমৎকার’ একটা সিস্টেমের মধ্য দিয়ে অমানুষ হয়। পরিবার থেকে রাষ্ট্র, সমাজ সব জায়গা থেকে সে অমানুষ হওয়ার উপকরণগুলো খুঁজে পায়। বৃষ্টির দিনে রিকশায় চড়তে গেলে সে দেখে ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে গেছে, শহরে বিদ্যুৎ না থাকলে পাঁচ টাকার মোমবাতি ২০ টাকা হাঁকায় দোকানদার, মিটারে না গিয়ে দ্বিগুণ ভাড়া চায় সিএনজিচালক। মুরগি কিনতে গেলে পাউন্ডের নিক্তিতে মেপে কেজির মাপে দিয়েছে বলে ঠকায় ক্রেতাকে। এভাবেই প্রতিদিন কোনো না কোনোখানে, কারও না কারও দ্বারা ঠকছি। এভাবে ঠকতে ঠকতে একদিন নিজেরাই ঠকানোর কৌশল খুঁজে পেয়ে যাচ্ছি। তারপর সুযোগ পেলেই অন্যকে ঠকাচ্ছি। মানুষ শব্দের সংযোগ থেকে আদর্শ, সৎ কিংবা মহৎ কথাগুলো একে একে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে এভাবেই।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন বুঝতে শিখি, তখন দেখি সমাজের প্রতিষ্ঠিত ও বড় মানুষগুলো দ্বারা আমরা নিগৃহীত। ওদের মতো ‘বড়’ হওয়ার ইচ্ছা তখন মনে জাগে প্রচণ্ডভাবে। এই ‘বড়’ হতে গিয়ে আমরা বিক্রি করে ফেলি নিজের জ্ঞান আর মনুষ্যত্বকে। ‘বড়’ হতে গিয়ে দিনে দিনে বড়দের দাসে পরিণত হই। নিজস্ব সত্তা ভুলে নিজের চিন্তা-চেতনাকে কাজে লাগাই এ ‘বড়দের’ ইচ্ছা-অনিচ্ছায়।
সামান্য একটু বড় হওয়ার ইচ্ছে আমাদের আরও ছোট করে তুলছেÑএই বোধটুকু আমাদের হারিয়ে যায়। নিজের মানবিক অনুভূতিগুলো দিনকে দিন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে, এটা আমরা বুঝতে পারি, তবু মেনে নিই।
যে ভুলের জন্য আমরা সমালোচনা করি মানুষের, সেই একই ভুল নিজেরা করি অহর্নিশ। অন্যকে ছোট করে নিজেকে বড় করার চেষ্টা আমাদের কুরে কুরে খায়, একেবারে নিঃশেষ করে দেয়। আমরা আমাদের নিঃশেষ হওয়াকে মেনে নিই নিদারুণভাবে! অথচ একটা সময় আমরা পৃথিবী বদলানোর স্বপ্ন দেখতাম।
সমাজে একসময় আদর্শ মানুষের কথা মনে হলে মনের ভেতর ভেসে উঠতো একজন শিক্ষক কিংবা ডাক্তারের মুখচ্ছবি। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি, এসব বিদ্যা পুঁথির পাতায় থেকে গেছে, বাস্তবে এসেছে অপ্রত্যাশিত অংশমাত্র।
প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকÑযিনিই হোন, তিনি এখন একজন সফল ব্যবসায়ী। সফল রাজনীতিবিদ। একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা না দিয়ে প্রজš§কে বানাচ্ছেন ‘প্রাইভেট-প্রজš§’। আর একজন ডাক্তার এতটাই বাণিজ্যিক মতাদর্শ লালন করেন, যেখানে মানবসেবা ভুলে কমিশনসেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমাদের মানুষরূপী দেহখাঁচায় আজ অমানুষের আত্মা বন্দি।
নিজেদের বানানো এ অমানুষ হওয়ার খাঁচায় আমরা নিজেরাও প্রবেশ করছি। নিজেরা না শোধরালে আমাদের এ অমানুষ হওয়ার ধারা চলছে, চলবে প্রজš§ থেকে প্রজš§তে।
ফারুক আহমেদ
ব্যবসায়ী ও উন্নয়নকর্মী