বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে ৩ বছরে লোকসান ছাড়াবে লাখ কোটি টাকা

ইসমাইল আলী: বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির জন্য গত জানুয়ারিতে প্রস্তাব দেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। গত সপ্তাহে সে প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি আয়োজন করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। শুনানিতে বিইআরসির কারিগরি কমিটি দাম বাড়ানোর পক্ষে মতামত দিলেও বিরোধিতা করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), এফসিবিসিআই-সহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন। তবে বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে লোকসানের বোঝা বাড়বে বলে মনে করছে পিডিবি।

সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে তিন বছরে পিডিবিকে এক লাখ ১৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হবে। এছাড়া প্রতি বছর লোকসানের পরিমাণ বাড়বে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছর পিডিবির বিদ্যুৎ বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াবে ৮৩ হাজার ৮৯৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট উৎপাদন ব্যয় পড়বে ৭০ হাজার ৫২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির আয় হবে ৪১ হাজার ৬৬৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর থেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলে জমা দিতে হবে এক হাজার ২২০ কোটি ৭০ লাখ টাকা। সে খরচ বাদ দিয়ে পিডিবির লোকসান দাঁড়াবে ৩০ হাজার ৭৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছর পিডিবির বিদ্যুৎ বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াবে ৯১ হাজার ২৬ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট উৎপাদন ব্যয় পড়বে ৮৪ হাজার ৩১০ কোটি ২০ লাখ টাকা। আর বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির আয় হবে ৪৪ হাজার ৮৫৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর থেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলে জমা দিতে হবে এক হাজার ৩২৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। সে খরচ বাদ দিয়ে পিডিবির লোকসান দাঁড়াবে ৪০ হাজার ৭৮০ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

আর ২০২৩-২৪ অর্থবছর পিডিবির বিদ্যুৎ বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াবে এক লাখ ১৩০ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট উৎপাদন ব্যয় পড়বে ৯০ হাজার ৬১০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির আয় হবে ৪৯ হাজার ৩৩৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর থেকে

বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলে জমা দিতে হবে এক হাজার ৪৫৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা। সে খরচ বাদ দিয়ে পিডিবির লোকসান দাঁড়াবে ৪২ হাজার ৭২৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

সব মিলিয়ে তিন অর্থবছরে পিডিবির লোকসান দাঁড়াবে এক লাখ ১৩ হাজার ৫৮৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। যদিও গত অর্থবছর পিডিবির লোকসান ছিল ১১ হাজার ৫০৯ কোটি ১২ লাখ টাকা।

পিডিবির বিশ্লেষণে আরও দেখানো হয়, চলতি অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় দাঁড়াবে আট টাকা ৬৭ পয়সা, আগামী অর্থবছর ৯ টাকা ৫৫ পয়সা ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯ টাকা ৩৩ পয়সা। আর বিদ্যুতের বিক্রি মূল্য কমে দাঁড়াবে প্রতি ইউনিট চলতি অর্থবছর পাঁচ টাকা ১২ পয়সা এবং পরের দুই অর্থবছর পাঁচ টাকা আট পয়সা। এ ঘাটতি পূরণে বাল্ক মূল্যহার বাড়িয়ে আট টাকা ৫৮ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে পিডিবি। তবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি না করলে সরকারকে ভর্তুকি বাড়াতে হবে।

সূত্রমতে, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির শুনানিতে বাল্ক মূল্য প্রতি ইউনিটে তিন টাকা ৩৯ পয়সা বা ৬৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করে পিডিবি। এক্ষেত্রে যুক্তি দেয়া হয়, ফার্নেস অয়েলের দাম ১২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে ১৬ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। আর আমদানিকৃত কয়লার দাম ১৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি করায় উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে দুই হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। একইভাবে ডিজেলের দাম ২০ শতাংশ বৃদ্ধি করায় উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে ৭১৮ কোটি টাকা।

এর বাইরে কয়লার ওপর সরকার পাঁচ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করেছে। এতে ব্যয় বাড়ছে ৩৩ কোটি টাকা। ফার্নেস অয়েলের ওপর সাড়ে ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এ খাতে ব্যয় বাড়ছে ছয় হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। এছাড়া বাল্ক বিদ্যুৎ বিতরণের ওপর উৎসে কর আরোপ করা হয়েছে ছয় শতাংশ। এতে অতিরিক্ত কেটে নেয়া হচ্ছে দুই হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। আর গ্যাসস্বল্পতার কারণে তরল জ্বালানির ব্যবহার বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ২৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে গেছে।

অপরদিকে পিডিবির প্রস্তাবের বিভিন্ন বিষয় যাচাই-বাছাই করে ইউনিটপ্রতি দুই টাকা ৯৯ পয়সা বা ৫৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ বাল্ক মূল্য বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বিইআরসির কারিগরি টিম। পাশাপাশি বাল্ক মূল্য বৃদ্ধির অনুপাতে গ্রাহক পর্যায়েও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তি দেয়া হয়, গ্রাহক পর্যায়ে না বাড়ালে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্য বৃদ্ধি কার্যকর করা সম্ভব নয়।

যদিও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামুসল আলম। তিনি বলেন, বিদ্যুৎকে সেবা খাতের পরিবর্তে বাণিজ্যিক খাতে পরিণত করেছে। এ খাতে শুল্ক-কর, ভ্যাট আরোপ করে লুণ্ঠনের একটি খাতে রূপান্তর করা হয়েছে। আর এ খাতে সরকার ভর্তুকি দিয়ে এলেও কারিগরি কমিটি ও পিডিবি কেউ তা বিবেচনা না করে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। অথচ ভর্তুকি বহাল রাখা হলে এবং শুল্ক-কর তুলে নেয়া হলে মূল্যহার বৃদ্ধির কোনো প্রয়োজনই পড়ে না।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০