ইসমাইল আলী: ২০১০ সাল থেকে বিদ্যুৎ খাতে বড় অঙ্কের লোকসান গুনছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম মূল্যে বিক্রি করায় এ লোকসান গুনতে হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটিকে। এজন্য ভর্তুকির পাশাপাশি গত এক দশকে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ৯ বার। সর্বশেষ গত বছর মার্চে দাম বাড়ানো হয় বিদ্যুতের। এর পরও চলতি অর্থবছর বিদ্যুতে রেকর্ড লোকসান করতে যাচ্ছে পিডিবি।
তথ্যমতে, চলতি অর্থবছর ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) পিডিবির লোকসান দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ২০৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু জানুয়ারি-মার্চ তিন মাসেই লোকসান হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। আর অর্থবছর শেষে লোকসান ১১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরার। এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছর রেকর্ড লোকসান করেছিল পিডিবি। সে বছর লোকসানের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
চলতি অর্থবছর লোকসান বৃদ্ধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে গ্যাস সরবরাহ হ্রাসকে। সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি অর্থবছর স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনার চেষ্টা করেছিল সরকার। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কেনা এলএনজি সরবরাহ নেয়া বন্ধ রাখা হয়। তবে হঠাৎ করেই আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম অনেক বেড়ে যায়। এতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়। যদিও এর প্রভাবে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে শীত মৌসুমে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়। আর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামও বেড়ে গেছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেশি পড়েছে। তবে এপ্রিল থেকে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ায় উৎপাদন ব্যয় কিছুটা কমবে। ফলে লোকসানের মাত্রা কিছুটা কমবে অর্থবছরের শেষ তিন মাসে (এপ্রিল-জুন)।
পিডিবির তথ্যমতে, বর্তমানে বিদ্যুতের গড় বিক্রি মূল্য দাঁড়িয়েছে পাঁচ টাকা ১২ পয়সা। আর মার্চশেষে বিদ্যুৎ সরবরাহে গড় ব্যয় দাঁড়িয়েছে ছয় টাকা ৬২ পয়সা। এতে প্রতি ইউনিটে লোকসান হচ্ছে এক টাকা ৫০ পয়সা।
এদিকে গত মার্চ শেষে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫১৫ মেগাওয়াট। এর মধ্যে পিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ছিল পাঁচ হাজার ৩৪৫ মেগাওয়াট ও সরকারি অন্যান্য সংস্থার কেন্দ্রগুলোর তিন হাজার ৬৭৩ মেগাওয়াট। আর বেসরকারি খাতে বড় তথা ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ৯ হাজার ৮৬ মেগাওয়াট ও ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) কেন্দ্রগুলোর ক্ষমতা এক হাজার ২৫১ মেগাওয়াট। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা হয় এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট।
এসব কেন্দ্রের মধ্যে চলতি অর্থবছর পিডিবি ও সরকারি অন্যান্য কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে কিছুটা মুনাফা হয়। তবে বেসরকারি খাত ও আমদানিকৃত বিদ্যুতে লোকসান গুনতে হয় পিডিবিকে। সার্বিকভাবে লোকসান বেড়ে গেছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছর মার্চ পর্যন্ত নিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৫০২ কোটি ১৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে উৎপাদন ব্যয় পড়ে ৩৫ হাজার ২৯০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এর সঙ্গে বাজেটারি সাপোর্টের সুদ যুক্ত হয়েছে ৯৭১ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন তহবিল ব্যয় ৮১৫ কোটি ১১ লাখ টাকা।
সব মিলিয়ে ৯ মাসে পিডিবির বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৭৭ কোটি সাত লাখ টাকা। আর বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির আয় দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৮৭২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এতে পিডিবির লোকসান হয়েছে ৯ হাজার ২০৪ কোটি ১০ লাখ টাকা।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. বেলায়েত হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, অর্থবছর শেষ হওয়ার আগে চূড়ান্ত হিসাব পাওয়া যাবে না, তাই লোকসান নিয়ে এখনই মন্তব্য করা যাচ্ছে না। তবে চলতি বছর গ্যাস সরবরাহ কম ছিল। এটি লোকসান বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
উল্লেখ্য, ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত এক দশকে ৬৩ হাজার ৬৩৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে পিডিবি। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসান ছিল চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। তবে ২০১২-১৩ অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে পিডিবি লোকসান গুনে ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।

Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 2:51 am
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পরও পিডিবির রেকর্ড লোকসান
দিনের খবর,প্রথম পাতা,বিদ্যুৎ-জ্বালানি ♦ প্রকাশ: