Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 1:32 am

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব শীতেই কার্যকর নতুন হার!

নিজস্ব প্রতিবেদক: গ্যাস সংকট ও জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে গত অর্থবছর রেকর্ড পরিমাণ লোকসান গুনে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। চলতি অর্থবছর বিশ্ববাজারে তেলের দাম আরও বেড়েছে। দেশেও বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে লোকসান তথা ভর্তুকি আরও বাড়াতে হবে। আর এ বোঝা কমাতে এবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চলতি শীতেই বিদ্যুতের বর্ধিত কার্যকর করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

সূত্রমতে, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব এরই মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রির ফলে গত (২০২০-২১) অর্থবছর পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫০৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। যদিও এ ঘাটতি মেটাতে ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। আর ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের দাম বৃদ্ধি এবং কয়লার আমদানি মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে ঘাটতি ১৮ হাজার কোটি টাকায় ঠেকতে পারে। বিশাল এ ঘাটতি মেটাতে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা প্রয়োজন।

প্রস্তাবনামতে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে পিডিবি দীর্ঘ সময় ধরে উৎপাদন ব্যয় অপেক্ষা কম মূল্যে বাল্ক (পাইকারি) বিদ্যুৎ বিক্রি করে যাচ্ছে। এতে প্রতি বছর পিডিবির আর্থিক ঘাটতি থাকছে। গত কয়েক বছরে তা বেড়েই চলেছে। যদিও তা পূরণে সরকার রাজস্ব বাজেটের আওতায় পিডিবিকে ভর্তুকি দিচ্ছে। এদিকে গ্যাস স্বল্পতার কারণে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। এতে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন বাড়াতে হয়েছে।

ডিজেলভিত্তিক এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় প্রতিদিন প্রায় ৪০ কোটি টাকার ডিজেল প্রয়োজন হচ্ছে। ফলে এ কেন্দ্রগুলোয় মাসিক খরচ হচ্ছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর পাঁচ হাজার ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেও প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এর অধিকাংশই আমদানি করা তেল দ্বারা পরিচালিত। আন্তর্জাতিক বাজারে এ তেলের দাম বেড়েই চলেছে। এছাড়া দেশে বিপিসির সরবরাহকৃত ফার্নেস অয়েলের দাম গত চার মাসে তিন দফা বাড়ানো হয়েছে।

এদিকে বিইআরসি বিদ্যুতের পাইকারি বিক্রয় মূল্য গড়ে পাঁচ টাকা ১৭ পয়সা নির্ধারণ করলেও প্রকৃতপক্ষে তা কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ টাকা ১২ পয়সা। আর গত অর্থবছর বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য ছিল ছয় টাকা ২৭ পয়সা। চলতি অর্থবছর তা প্রায় সাত টাকায় ঠেকবে। এ ঘাটতি পূরণে বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করা প্রয়োজন।

পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব এরই মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে মূল্য বৃদ্ধির নির্দিষ্ট কোনো হার প্রস্তাব করা হয়নি। এক্ষেত্রে পিডিবির আয় ও ব্যয়ের সম্ভাব্য চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সার্বিক চিত্র তুলে ধরে মূল্য সমন্বয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। কতটুকু মূল্য বৃদ্ধি করা হবে তা বিবেচনা করবে বিইআরসিতে (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন)। বাকিটা ভর্তুকি দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়।

তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও বিদ্যুৎ সচিব ফ্রান্স সফরে থাকায় প্রস্তাবটি বিইআরসি এখনও জমা দেয়া হয়নি। প্রতিমন্ত্রী ও সচিব দেশে এলে তাদের কনসার্ন নিয়েই প্রস্তাবটি জমা দেয়া হবে। আর বাল্ক মূল্য বৃদ্ধির অনুপাতে খুচরা তথা গ্রাহক পর্যায়েও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হবে। যেহেতু শীতে বিদ্যুতের ব্যবহার কম থাকে। ফলে এ সময় বিদ্যুৎ বিল কম আসে। তাই এ শীতেই নতুন মূল্যহার কার্যকর করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

এ বিষয়ে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. বেলায়েত হোসেনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমি এখন দেশের বাইরে আছি। ১৪ নভেম্বর (আজ) দেশে ফিরব, তারপর এ বিষয়ে কথা হবে।’

উল্লেখ্য, ২০২০ সালের মার্চে সর্বশেষ বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়। অর্থাৎ দুই বছরের মধ্যেই নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়তে যাচ্ছে।

তথ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০১০ সাল থেকে গ্রাহক পর্যায়ে ৯ বার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১০ সালের মার্চে প্রথম বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। সে সময় গড় বিদ্যুৎ বিল বেড়ে দাঁড়ায় ৩ টাকা ৯২ পয়সা। পরের বছর (২০১১ সাল) গ্রাহক পর্যায়ে দুই দফা বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বাড়ানো হয় ৫ শতাংশ ও ডিসেম্বরে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এতে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪ টাকা ৬৭ পয়সা।

২০১২ সালেও খুচরা বিদ্যুতের দাম দুই দফা বাড়ানো হয়। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বাড়ে ৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ ও সেপ্টেম্বরে বাড়ে ১৫ শতাংশ। এতে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে বিদ্যুতের গড় মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। এরপর ২০১৪ সালের মার্চে বিদ্যুতের দাম ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয় ৬ টাকা ১৫ পয়সা। আর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তা ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেড়ে হয় ৬ টাকা ৩৩ পয়সা।

এদিকে ২০১৭ সালে ডিসেম্বরে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। সে সময় বিদ্যুতের গড় মূল্যহার ৬ টাকা ৮৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে ওইবারই প্রথম বিদ্যুৎ বিতরণকারী সবগুলো কোম্পানির জন্য অভিন্ন মূল্যহার নির্ধারণ করা হয়। এতে ঢাকার চেয়ে বেশি গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের দাম বেশি হারে বাড়ে। এতে মূল্যহার কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে গড়ে ৬ টাকা ৭৭ পয়সা। আর সর্বশেষ গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্যহার ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে গড় মূল্যহার দাঁড়িয়েছে ৭ টাকা ১৩ পয়সা।

যদিও বিদ্যুতের এ দাম বৃদ্ধির উদ্যোগকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন ভোক্তা সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতে ‘অযৌক্তিক’ ব্যয় না কমিয়ে সরকার জনগণের ব্যয়ভার বাড়িয়ে দিয়েছে। বরাবরই গতানুগতিক ঐকিক নিয়মে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করার প্রতি নির্দেশনা থাকে না। এ খাতে অযৌক্তিক ব্যয় সমন্বয় করা হলে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির দরকার হতো না। এছাড়া কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রয়োজন না থাকলেও বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ অর্থ দেয়া হচ্ছে। এ কারণেই পিডিবির ঘাটতি বাড়ছে। এ ধরনের কাজের দায়ভার চাপানো হচ্ছে জনগণের ওপর।