নিজস্ব প্রতিবেদক: বিদ্যুতের দাম প্রথমবারের মতো কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির লিখিত প্রস্তাবে বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি এক টাকা ৩২ পয়সা কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে। যদিও বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানিগুলো দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে, যার ওপর গণশুনানি চলছে। তবে এবার ক্যাবের প্রস্তাবের ভিত্তিতে বিদ্যুতের দাম কমানোর ওপর পৃথক শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
আগামী ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এ গণশুনানির দিন ধার্য করেছে। গতকাল ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) শুনানির সময় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে বিদ্যুৎ বিতরণকারী সব সংস্থা ও কোম্পানির প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
গত ২১ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দাম না বাড়ানো ও উদ্বৃত্ত অর্থ সমন্বয়ে দাম হার কমানোর জন্য বিইআরসির কাছে আবেদন করেছে ক্যাব। বিইআরসি আইনের ২২(ক), ২২(ট), ৩৪(২)(খ), ৩৪(২)(গ) ও ৩৪(২)(ঘ) ধারা এবং উপধারাগুলোর আওতায় আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বিশ্লেষণ প্রতিবেদন মতে পাইকারি বিদ্যুতের দাম এক টাকা ৩২ পয়সা কমানোর আবেদন করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, বিইআরসির দায়িত্ব জ্বালানি/বিদ্যুৎ ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি ও সে সঙ্গে সাশ্রয় নিশ্চিত করা, অসাধু বিদ্যুৎ বা জ্বালানি ব্যবসা কিংবা মনোপলি ব্যবসা সম্পর্কিত বিরোধের প্রতিকার নিশ্চিত করা, বিদ্যুতের দাম হারের সঙ্গে যৌক্তিক উৎপাদন ব্যয় হার সামঞ্জস্যপূর্ণ করা, ন্যূনতম বা স্বল্পতম বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় নিশ্চিত করা ও ভোক্তাস্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
স্বল্পতম ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিতকরণে বিইআরসির আদেশ প্রতিপালিত না হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির চাপ বাড়ছে। পাইকারি বিদ্যুতের দাম হার বৃদ্ধির প্রস্তাব তারই প্রমাণ। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত জ্বালানি মিশ্রে গ্যাস, ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের অবদানই মুখ্য। তাতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের হিসাবে গ্যাস ৬৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ, ফার্নেস অয়েল ১৭ দশমিক ২৮ শতাংশ ও ডিজেল চার দশমিক ১১ শতাংশ।
এতে আরও বলা হয়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ব্যবহার ৫০১৯ কোটি ৩২ লাখ ইউনিট। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৩৯১ কোটি ৫০ লাখ ইউনিট। বর্তমানে পাইকারি বিদ্যুতের দাম হার ভারিত গড়ে চার টাকা ৯০ পয়সা। কিন্তু পাঁচ পয়সা ঘাটতিতে সে মূল্যহার চার টাকা ৮৫ পয়সা ধরে ৭২ পয়সা রাজস্ব ঘাটতি পূরণে দামবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ স্বল্পতম ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়হার কমানোর কোনো কৌশল গ্রহণ করা হয়নি। ফলে পাইকারি বিদ্যুতে আর্থিক ঘাটতি বাড়ছে। সে ঘাটতি সমন্বয়ের অজুহাতে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিইআরসিতে প্রক্রিয়াধীন দামহার বৃদ্ধির ওই প্রস্তাব। ফলে এ প্রস্তাব ন্যায্য ও যৌক্তিক নয়। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদনে আর্থিক ঘাটতি ও ক্ষতি খতিয়ে দেখা হয়েছে। তারই ভিত্তিতে ক্যাব পাইকারি বিদ্যুতের দামহার এক টাকা ৩২ পয়সা কমানোর প্রস্তাব করেছে।
আবেদনে দাম হার কমানোর যৌক্তিকতায় বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল বাবদ ২৬ পয়সা, ভর্তুকির সুদ বাবদ ২১ পয়সা, পাইকারি বিদ্যুতের দাম হারে ঘাটতি পাঁচ পয়সা, দরপতন সমন্বয়কৃত দাম হারে ফার্নেস অয়েল পরিবর্তে মেঘনাঘাট আইপিপিতে ডিজেল ব্যবহারে ঘাটতি ১৪ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। তবে এটা না বাড়িয়ে কমানো সম্ভব। অন্যদিকে আয়হারে অন্তর্ভুক্ত হয়নি ভোক্তাপর্যায়ে ১৩২ কেভি লেভেলে বিদ্যুৎ বিক্রিতে উদ্বৃত্ত আয় আট পয়সা ও পাওয়ার ফ্যাক্টর জরিমানা আদায় বাবদ আয় চার পয়সা। সর্বমোট এ ৭৮ পয়সা প্রস্তাবিত দামহার বৃদ্ধিতে সমন্বয় হলে উদ্বৃত্ত হয় ৩২১ কোটি টাকা। তাতে দামহার ৭২ পয়সা বাড়ানো নয়, ছয় পয়সা কমানো যায়।
এদিকে যদিও গ্যাসে মেঘনাঘাট আইপিপিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো তাহলে ব্যয় সাশ্রয় হতো এক হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। গ্যাসভিত্তিক ভাড়া-দ্রæত ভাড়া বিদ্যুৎ তিন টাকা ৩৭ পয়সা দাম হারে কেনার পরিবর্তে ওই গ্যাসে সরকারি খাত উৎপাদন ক্ষমতায় শুধু ৮৬ পয়সা জ্বালানি ব্যয় হারে ওই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত। ব্যয় সাশ্রয় হতো এক হাজার ৩০১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির দরপতন সমন্বয় সমতা নিশ্চিত হলে ব্যয় সাশ্রয় হতো দুই হাজার ১১২ কোটি টাকা। বেশি দামি ডিজেল বিদ্যুৎ কম উৎপাদন করার কৌশল গৃহীত হলে সাশ্রয় হতো ৭৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ভাড়া-দ্রæত ভাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট যৌক্তিক হলে নন-ফুয়েল ব্যয় হার অনুসরণে সাশ্রয় হতো ৮৫৫ কোটি ৮০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে উৎপাদন ব্যয় সাশ্রয় হতো কমপক্ষে ছয় হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ উৎপাদন ব্যয়হার হ্রাস পেত এক টাকা ২৬ পয়সা। সব মিলিয়ে এক টাকা ৩২ পয়সা বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব।
ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম এ সিদ্ধান্তকে যুগান্তকারী বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘উৎপাদন ব্যয় হ্রাস সাপেক্ষে বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট পাইকারি দাম এক টাকা ৩২ পয়সা কমানো সম্ভব। আমরা হিসাব করে দেখিয়েছি, গণশুনানিতে তা প্রমাণ করে দেওয়া হবে।’