হোসাইন মুবারক : কয়েক দিন আগে জাতীয় দৈনিকগুলোয় ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পুনরায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদনমুখী শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, স্টিল রি-রোলিং, টেক্সটাইল খাতে প্রায় আট থেকে ১০ শতাংশ উৎপাদন-ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। সেসঙ্গে প্রতিযোগী মূল্যে শিল্প-উৎপাদন সক্ষমতা ব্যাহত হবে। এছাড়া বৃহৎ অবকাঠামো উন্নয়ন, রফতানি সক্ষমতা, শিল্প বহুমুখীকরণ, এসএমই খাত, বিদেশি বিনিয়োগ ও ব্যবসা পরিচালনায় ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে।
বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবিত পুনরায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ খুচরা পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ৯ টাকা ১৬ পয়সা থেকে ১০ টাকা, বাণিজ্যিক ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৯৮ পয়সা, বৃহৎ শিল্প-কারখানার ক্ষেত্রে ৯ টাকা ৫২ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৩২ পয়সা এবং গৃহস্থালিতে ব্যবহারের ক্ষেত্রে পাঁচ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে ছয় টাকা ১০ পয়সা হারে বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ইতোমধ্যে কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব যাচাই-বাছাই শেষ করেছে। পাইকারিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে ছয় থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করতে ছয়টি বিতরণ কোম্পানির প্রস্তাবের ওপর এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ২৫ সেপ্টেম্বর গণশুনানি শুরু করেছে। এটি চলবে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত। এতে অংশ নেবে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ প্রতিষ্ঠান। এ কোম্পানিগুলোর দাবি, প্রতিবারই পাইকারির তুলনায় খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়েছে কম।
গ্যাস ও বিদ্যুৎ শিল্প-কারখানার জ্বালানিশক্তির প্রধান উৎস। এর আগে গ্যাসের মূল্য দুই দফা বাড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে আদালতে শরণাপন্ন হয়ে কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছেন গ্রাহকরা। সাধারণ গ্রাহকদের জন্য ৪৫০ টাকার গ্যাস প্রথম দফায় ৬৫০ টাকা, এরপর দ্বিতীয় দফায় ৯৫০ টাকা করা হয়েছিল। অবশেষে আদালতের আদেশে ৮০০ টাকায় স্থির করা হয়। দেশের তৃণমূলে শুধু আবাসিক গ্রাহক ২০ লাখের বেশি। দাম বাড়লেও অনেক জায়গায় দিনের অধিকাংশ সময় নিভু নিভু করে জ্বলছে চুলা।
শিল্প-কারখানায়ও বাড়তি মূল্য আর গ্যাসের নিম্ন প্রবাহে নাকাল উৎপাদনব্যবস্থা। এসময়ে আবারও বাড়তে যাচ্ছে বিদ্যুতের মূল্য।
কিছুদিন আগে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৩০-৩৫ পয়সা বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী। তার হিসাবে দাম বৃদ্ধির হার পাঁচ শতাংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন মূল্যের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের সমন্বয় করতে এটি করা হতে পারে বলে মন্ত্রী তখন জানিয়েছিলেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, বারবার কেন বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। উত্তরে বলা হবে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ভিন্ন চিত্রও রয়েছে, জ্বালানি তেলচালিত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আগে থেকে স্বল্প মূল্যে তেল আমদানির সুবিধা পাচ্ছে। তারপর বিদ্যুতের উচ্চমূল্য রয়ে গেছে।
দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াকে অযৌক্তিক মন্তব্য করে ক্যাবের (কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বলেছেন, বিইআরসির পরামর্শমতো সরকার কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ অনুসরণ করছে না। বরং বেশি দামের তেলভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। পদ্ধতিগত লোকসান কমিয়ে মুনাফা বাড়ানোর কার্যক্রমও যথেষ্ট সফল নয়। ব্যবসায়ীদের মুনাফার জন্যই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে এ বিশেষজ্ঞ মনে করেন।
ক্যাব উপদেষ্টার অভিমত কতটা যৌক্তিক, তা খতিয়ে দেখতে হবে। বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়বে আর কোম্পানিগুলোর জবাবদিহি থাকবে না, এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে একসময় শিল্প খাত ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটিও ঠিক, উৎপাদন কোম্পানি সরকারি, বেসরকারি যা-ই হোক, কখনই অব্যাহত লোকসানে উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারবে না। উৎপাদন খরচের চেয়ে কিছুটা হলেও বেশি দামে বিতরণ করতে হবে। তাই খতিয়ে দেখতে হবে সংকট কোথা থেকে হচ্ছেÑউৎপাদনে না বিতরণে। যেখানেই হোক, নিজেদের দায় গ্রাহকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। মূল্য বৃদ্ধিতেই সব সমাধান, এমন ভাবনা পরিহার করে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক বিধি প্রতিষ্ঠা করা দরকার।
২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় বছরে পাইকারি পর্যায়ে পাঁচবার এবং গ্রাহক পর্যায়ে সাতবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এটাই সরকারকে ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ কর্তৃপক্ষের বিদ্যুৎ কিনে যে শিল্পমালিকরা ওই সব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক উৎস হিসেবে কাজ করে, তাদের শিল্পই যদি ব্যয়ভারে নিমজ্জিত হয়, তাহলে তাদের রাজস্ব জোগাবে কে?
আবারও প্রশ্ন আসে, পিডিবি কেন দিনের পর দিন প্রতি ইউনিটে বিদ্যুতে লোকসান দিয়ে যাবে। আগে তো বিতরণব্যবস্থা পিডিবির আওতায় ছিল। তখন লোকসান থেকে বেরিয়ে আসতে সরকার কয়েকটি বিতরণ
কোম্পানি সৃষ্টি করে। তাতেও যদি রক্ষা না হয় তাহলে শেষ সমাধান কোথায়?
তেলভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদিত যে বিদ্যুৎ জাতীয় সঞ্চালন লাইনে যুক্ত হয়, তা আমদানি করা জ্বালানি তেল দিয়ে পরিচালিত। বেসরকারি খাতের ফার্নেস অয়েল অথবা হেভি ফুয়েল অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা বিপিসির প্রদানকৃত দরের তুলনায় প্রায় ৯০ শতাংশ কম মূল্যে ফার্নেস অয়েল অথবা হেভি ফুয়েল অয়েল আমদানি করতে পারে। সে তুলনায় বিদ্যুৎ কতটা সাশ্রয়ী মূল্যে দিতে পেরেছে, সেটাও একটা প্রশ্ন।
বিদ্যুতের স্বল্প উৎপাদন ব্যয় নিশ্চিত করতে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে দেওয়া যায় কি না, তা সরকারকে ভাবতে হবে।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মতো পিডিবিকে শুল্কমুক্তভাবে জ্বালানি তেল আমদানি করতে অনুমতি দেওযা হলে রাষ্ট্র কী পরিমাণ রাজস্ব হারাবে, তাও সরকারকে ভাবতে হবে। এটা কোনোভাবেই যেন যৌক্তিক মাত্রা অতিক্রম না করে।
নজর দিতে হবে সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের পরিচালন ও ব্যবস্থাপনা, দক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, সিস্টেম লস, বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ কার্যক্রম প্রভৃতিতেও। এসবে শৃঙ্খলা আনা গেলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে না বলে অনেকের অভিমত।
গণমাধ্যমকর্মী
mubarokhosen83Ñgmail.com
Add Comment