Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 3:20 am

বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহারই পারে বিদ্যুৎ বিল নিয়ন্ত্রণ করতে

মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন: নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এখন সময়ের দাবি। এক সেকেন্ডের জন্যও যদি বিদ্যুৎ না থাকে অস্বস্তি থেকে অসন্তোষ শুরু হয়ে যায়। সরকারের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ১২.১৩ টাকা এবং বাল্কে বিক্রয় করে ৭.০৪ টাকা। বছরে প্রায় ৯ হাজার কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে বছরে যে বিশাল পরিমাণ অর্থের ঘাটতি থাকে তা চিন্তার বিষয়। এ ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে আপনার-আমার প্রত্যেকেরই দায়িত্বশীল অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। আমরা সচেতন হলেই নিজের বিদ্যুৎ বিল নিজেই নির্ধারণ করতে পারি অর্থাৎ বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহারই করে আমরা বিদুৎ বিল কমিয়ে আনতে পারি।

একটু সচেতনভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে আমাদের বিদ্যুৎ বিল কম আসবে এতে একদিকে যেমন ব্যক্তি উপকৃত হবে, তেমনি এ খাতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয় তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। আমরা বাসাবাড়িতে যেসব বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করি তাতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় সে বিষয়ে আমাদের ধারণা থাকা দরকার। আমাদের বাসা বাড়িতে সবাই ফ্যান ব্যবহার করি। সাধারণ হিসাব হলো একটি লাইট (সিএফএল, ২৩ ওয়াট) প্রায় ৪৩ ঘণ্টা চালু রাখলে ১ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয় এবং একটি  টিউবলাইট (৪০ ওয়াট) প্রায় ২৫ ঘণ্টা চালু রাখলে ১ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। ঠিক একইভাবে একটি সিলিং ফ্যান (৭৫ ওয়াট) প্রায় ১৩ ঘণ্টা ব্যবহার করলে ১ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হবে। আমরা যদি বিনা কারণে লাইট-ফ্যান না ব্যবহার করি তাহলে অনায়াসেই বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে খরচ কমাতে পারি।

পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হওয়ার কারণে এখন ফ্রিজ ব্যবহার করে না এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া দায়। ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, আয়রন, ইন্ডাকশন কুকার, রাইস কুকার এগুলো কোনো বিলাসিতার বিষয় নয়। এগুলো এখন নিত্যব্যবহার্য। ২০০ ওয়াটের একটি ফ্রিজ প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ব্যবহার করলে ১ ইউনিট এবং এক হাজার ওয়াটের একটি ওয়াশিং মেশিন এক ঘণ্টা ব্যবহার করলে ১ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। আয়রন, গিজার এবং ইন্ডাকশন কুকারে বিদ্যুৎ খরচ তুলনামূলক অনেক বেশি। তাই এগুলো ব্যবহারে বেশি সচেতন হতে হবে। এক ঘণ্টা একটি আয়রন, আধা ঘণ্টা একটি গিজার এবং একটি ইন্ডাকশন কুকার প্রায় আধা ঘণ্টা ব্যবহার করলে ১ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। গ্রীষ্মে দাবদাহে মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। দিনের তাপমাত্রা কমবেশি ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশেই থাকছে। এ গরম থেকে সাময়িক রেহাই পেতে কেউ যদি ২৫ মিনিট দুই টনের একটি এসি ব্যবহার করে তাহলে বিদ্যুৎ খরচ হবে এক ইউনিট। টেলিভিশন, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন ছাড়া কি জীবন চলে? এগুলো ব্যবহার করলেও বিদ্যুৎ খরচ হবে, তবে সচেতনভাবে করলে খরচ অনেক কম হবে।

এখানে উল্লেখ্য, বাসাবাড়িতে ব্যবহƒত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ব্র্যান্ড ও প্রযুক্তি অনুযায়ী পাওয়ার রেটিং কমবেশি হয়ে থাকে। তাছাড়া বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি কত ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারে সেটি উক্ত যন্ত্রের পাওয়ার রেটিং এবং ব্যবহƒত সময়ের ওপর নির্ভর করে। পাওয়ার রেটিংকে (ওয়াট) বিদ্যুৎ ব্যবহারের সময় (ঘণ্টা) দিয়ে গুণ করে এক হাজার দিয়ে ভাগ করলে বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ বা ইউনিট (কিলোওয়াট-ঘণ্টা) পাওয়া যায়।

ধরা যাক, একটি উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে দুটি এসি, চারটি ফ্যান,পাঁচটি লাইট ও ১টি টিভি চালু রয়েছে; তাহলে ওই পরিবারের বিদ্যুৎ খরচ কেমন হতে পারে, আমরা যদি একটু হিসাব করি: ক) একটি এক টনের এসি যদি সারা দিনে ৮ ঘণ্টা চলে তবে  (১২০০–৮)/১০০০ =৯.৬ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হবে। মাসে খরচ করবে ৩০–৯.৬= ২৮৮ ইউনিট। ২টি এক টনের এসি এক মাসে বিদ্যুৎ খরচ করবে ৫৭৬ ইউনিট। এখানে উল্লেখ্য, এসির কম্প্রেসারের ডিজাইনগত কারণে একটা এসি ১ ঘণ্টা চালানো হলে সাধারণত প্রায় ১০ মিনিট কম্প্রেসার বন্ধ থাকে। খ) উন্নতমানের একটি সিলিং ফ্যানের পাওয়ার রেটিং প্রায় ৭৫ ওয়াট। যদি একটি সিলিং ফ্যান দিনে ১৪ ঘণ্টা চলে (সাধারণত আরও বেশি চলে) তবে (৭৫–১৪)/১০০০ =১.০৫ ইউনিট বা ১ ইউনিট, মাসে একটি সিলিং ফ্যান বিদ্যুৎ খরচ হবে ৩০–১=৩০ ইউনিট, মাসে ৪টি সিলিং ফ্যান বিদ্যুৎ খরচ করবে ৩০–৪=১২০ ইউনিট, গ) একটি টিউবলাইট সাধরণত ১ ঘণ্টায় ৪০ ওয়াট বিদ্যুৎ খরচ করে। দিনে ১২ ঘণ্টা জ্বললে  (৪০–১২)/১০০০ =০.৪৮ ইউনিট, মাসে বিদ্যুৎ খরচ করবে ১৪.৪ ইউনিট, পাঁচটি টিউব লাইটে মাসে বিদ্যুৎ খরচ হবে ১৪.৪–৫=৭২ ইউনিট, এখানে ওয়াশরুমে কম পাওয়ার রেটিংয়ের বাল্ব ও সময়কাল কম হওয়ায় হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে। ঘ) প্রতিটি বাসায় এখন টেলিভিশন রয়েছে। টিভির পাওয়ার রেটিং ১০০ ওয়াট, টিভি ১০ ঘণ্টা চললে (১০০–১০)/১০০০ = ১ ইউনিট। অর্থাৎ একটি টিভি দিনে ১০ ঘণ্টা চালু অবস্থায় ১ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। তাই মাসে বিদ্যুৎ খরচ করবে ৩০ ইউনিট। ঙ) আয়রন, গিজার, ওয়াশিং মেশিন, রাইস কুকার, মাইক্রোওয়েব ওভেন, ডেস্কটপ কম্পিউটার বা ল্যাপটপ  বাসাবাড়িতে এখন প্রায়ই ব্যবহার করতে দেখা যায়। তারপরও হিসেবের বাইরে রাখলে উক্ত গ্রাহকের দুটি এসি, চারটি সিলিং ফ্যান, পাঁচটি টিউব লাইট ও একটি টেলিভিশনের জন্য মোট বিদ্যুৎ খরচ হবে (৫৭৬+১২০+৭২+৩০)=৭৯৮ ইউনিট। অর্থাৎ সিংহভাগ বিদ্যুৎ এয়ার কন্ডিশনেই ব্যবহƒত হয়। ফ্যান ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো বা বাড়ানোর জন্য ৩ ধরনের রেগুলেটর ব্যবহার হয়। কনভেনশন ফ্যান রেগুলেটর, ক্যাপাসিটিভ ফ্যান রেগুলেটর ও ফেজ অ্যাঙ্গেল কন্ট্রোল ফ্যান রেগুলেটর। ক্যাপাসিটিভ ফ্যান রেগুলেটর ব্যবহার করা হলে ফ্যান ধীরে ঘুরলে কম বিদ্যুৎ ব্যবহার হবে এবং জোরে ঘুরলে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার হবে। ইনভার্টার ও নন ইনভার্টার এই দুই ধরনের এয়ার কন্ডিশনার বিদ্যমান রয়েছে। ইনভার্টার এয়ার কন্ডিশনার নন ইনভার্টার এয়ার কন্ডিশনারের তুলনায় অধিক বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে থাকে।

এখন বিদ্যুৎ বিল নিয়ে আলোচনা করা যাক। এলটি-এ আবাসিক গ্রাহকের ক্ষেত্রে, ০-৭৫ ইউনিটের মূল্য ৫.২৬ টাকা, ৭৬-২০০ ইউনিটের মূল্য ৭.২০ টাকা, ২০১-৩০০ ইউনিটের মূল্য ৭.৫৯ টাকা, ৩০১-৪০০ ইউনিটের মূল্য ৮.০২ টাকা, ৪০১-৬০০ ইউনিটের মূল্য ১২.৬৭ টাকা এবং ৬০০ ইউনিটের ঊর্ধ্বে ১৪.৬১ টাকা হিসেবে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের মূল্য কর্তন করা হয়ে থাকে। ওই গ্রাহক মাসে ৭৯৮ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে খরচ আসে-০-৭৫ ইউনিটের মূল্য = ৭৫ – ৫.২৬ = ৩৯৪.৫০ টাকা, ৭৬-২০০ ইউনিটের মূল্য= ১২৫–৭.২০ = ৯০০.০০ টাকা.২০১-৩০০ ইউনিটের মূল্য= ১০০ – ৭.৫৯ = ৭৫৯.০০ টাকা, ৩০১-৪০০ ইউনিটের মূল্য= ১০০–৮.০২ = ৮০২.০০ টাকা, ৪০১-৬০০ ইউনিটের মূল্য= ২০০–১২.৬৭ = ২,৫৩৪.০০ টাকা, ৬০১-৬২২ ইউনিটের মূল্য = ১৯৮–১৪.৬১ = ২৮৯.৭৮ টাকা। অর্থাৎ উক্ত গ্রাহকের বাসায় দুটি এসি, চারটি ফ্যান, পাঁচটি বাল্ব ও একটি টেলিভিশনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে, প্রতি মাসে ৭৯৮ ইউনিটের এনার্জি চার্জ বাবদ প্রায় ৮২৪২.২৮ টাকা ব্যয় হবে। এনার্জি চার্জের সঙ্গে ডিমান্ড চার্জ (প্রতি কিলোওয়াট ৪২ টাকা হারে, ৫ কিলোওয়াট অনুমোদিত লোডের বিপরীতে ২১০ টাকা প্রায়), মিটার রেন্ট (সিঙ্গেল ফেজ ৪০ টাকা, থ্রি-ফেজ ২৫০ টাকা) এবং ভ্যাট (৫% হারে যা প্রায় ৩০০ টাকার ঊর্ধ্বে) যুক্ত হবে। অর্থাৎ এসির ব্যবহার না হলে বা আরও সীমিত হলে ওই গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিল অনেক কম হবে।

প্রিপেইড মিটার প্রতি মাসে ১ম বার রিচার্জ করার সময় ০৩ (তিন) ধরনের চার্জ কেটে রাখা হয়, যথা: ডিমান্ড চার্জ, মিটার রেন্ট এবং ভ্যাট। একই মাসে ২য় বার রিচার্জের ক্ষেত্রে শুধু ভ্যাট কেটে রাখা হয়। তথাপি, গ্রাহক রিবেট হিসেবে ০.৫% হারে টাকা ফেরত পান। বাকি সম্পূর্ণ টাকা মিটারের এনার্জি ব্যালান্স হিসেবে মিটারে যুক্ত হয়। শুধু এনার্জি চার্জ প্রি-পেইড মিটার দ্বারা বিদ্যুৎ ব্যবহারের ফলে মিটার থেকে ধীরে ধীরে কেটে নেয়া হয়। মাসের শুরুতে, মধ্যবর্তী সময়ে বা মাসের শেষদিকে বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ট্যারিফ অনুযায়ীই মিটার থেকে টাকা কাটা হয়ে থাকে। শুধু গ্রাহকের বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণের সঙ্গেই মিটার থেকে টাকা কাটার সম্পর্ক রয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বিক্রয়ের চেয়ে অনেক বেশি। সরকারকে এখাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দিতে হয়। এই প্রণোদনা থেকে সরকার বেরিয়ে এলে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ গ্রাহকদেরকেই বহন করতে হবে। তাই প্রতি মুহূর্তে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সচেতনতা ও সাশ্রয়ী হওয়া বাঞ্ছনীয়।

বিদ্যুৎ গ্রাহকরা বিদ্যুৎ পরিবারের একেকজন সদস্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রাহকের বিভিন্ন অভিযোগ বা মতামত কিংবা কল সেন্টার (১৬৯৯৯)-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত যেকোনো অভিযোগ বা মতামত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে উক্ত সমস্যা সমাধানের বিষয়ে   কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত সচেষ্ট। সচেতন গ্রাহকের সুচিন্তিত মতামত ও পরামর্শে ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো একটি গ্রাহক বান্ধব স্মার্ট ইউটিলিটিতে পরিণত হবে এটাই প্রত্যাশিত।

বিদুতের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক রয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিদ্যুৎ খাত প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে। যৌক্তিক ও সহনীয় মূল্যে সবার জন্য এবং শিল্প, সেবাসহ সব খাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য সবাইকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে। এতে ব্যক্তি, সমাজ এবং দেশ উপকৃত হবে।

পিআইডি নিবন্ধ