Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 1:19 am

বিদ্যুতে ৭৯ হাজার কোটি টাকার দায় রেখে পালিয়েছেন হাসিনা!

ইসমাইল আলী: আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতি বেশি জোর দেয়া হয়। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ৭৯১ মেগাওয়াট দাঁড়ালেও বাস্তবে তার অর্ধেকও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। প্রাথমিক জ্বালানি তথা গ্যাস ও তেলের সংকটে গতকাল ৪৫টি কেন্দ্র পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক বন্ধ ছিল। নিয়মিত বিল পরিশোধ না করায় বেসরকারি কেন্দ্রগুলো নিয়মিত ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে পারছে না। ভারতও বিদ্যুৎ রপ্তানি কমিয়ে দিয়েছে ২২ শতাংশের মতো। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি নাজুক।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, বর্তমানে পিডিবির দায়দেনা রয়েছে প্রায় ৭৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল বকেয়া পড়েছে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি। এছাড়া তহবিল সংকটে পিডিবি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের কিস্তিও নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না। বিদ্যুৎ খাতকে এমন নাজুক অবস্থায় রেখে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন। বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির সাময়িক কোন সমাধান না পেয়ে লোডশেডিংয়ের বিকল্প দেখছে না সংস্থাটি।
সম্প্রতি পিডিবি তাদের আর্থিক অবস্থার চিত্র বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের সামনে তুলে ধরে। এতে দেখা যায়, বিভিন্ন গ্যাস কোম্পানির কাছে পিডিবির বকেয়া বিল রয়েছে ১৫ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বকেয়া চার হাজার ৭৪ কোটি টাকা ও আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) তথা বেসরকারি খাতের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বকেয়া ১১ হাজার ১৫২ কোটি টাকা।

এর বাইরে আইপিপিগুলো থেকে কেনা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে ৩০ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা ও ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদনির বিল বকেয়া আট হাজার ২৫২ কোটি টাকা বা প্রায় ৭০ কোটি ডলার। যদিও গত জুলাই শেষে এ বকেয়া বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ কোটি ডলার এবং আগস্ট শেষে ১০৪ কোটি ডলার। পিডিবির ঋণের কিস্তি বকেয়া রয়েছে ৮২ কোটি ডলার, যার মধ্যে সরাসরি ডলারে পরিশোধ করতে হবে ৬৬ কোটি ডলার। বাকিটা ইয়েন ও ইউরোতে পরিশোধ করতে হবে। এ ঋণের কিস্তি পিডিবিকে সরাসরি পরিশোধ করতে হবে।
এদিকে বিভিন্ন সময় সরকার যেসব ঋণ পিডিবিকে নিয়ে দিয়েছে, সেসব ঋণের কিস্তি বাবদ বকেয়া পড়েছে আরও ১৬ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। এ অর্থ সরাসরি পিডিবিকে পরিশোধ করতে হয় না। পিডিবির ঋণের কিস্তি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) পরিশোধ করা হয়। আর পিডিবি ডিএসএল বাবদ সে অর্থ ইআরডিকে পরিশোধ করে।

সূত্র জানায়, যদিও গত অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি বাবদ ৩৩ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে সরকার, তবে তা পুরোটা নগদ দেয়া হয়নি। বন্ডের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে ২০ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা, যা সরকারের দীর্ঘমেয়াদি দায় সৃষ্টি করেছে। আর ভর্তুকি বাবদ এখনও সরকারের পিডিবির পাওনা রয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ অর্থ পেলে আইপিপি ও গ্যাসের বকেয়া বিল পরিশোধ করতে পারবে পিডিবি।
অন্যদিকে বর্তমানে দেশে ১৪৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ৪৩টি সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে, যার কারণে উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ৭৯১ মেগাওয়াট হলেও গতকাল দিনে সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ১২ হাজার ৮৬৯ মেগাওয়াট। এ সময় প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। তবে গতকাল (১০ সেপ্টেম্বর) রাত ১২টায় সর্বোচ্চ দুই হাজার ৩১২ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল, যা গত দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বর্তমানে বন্ধ থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে যেগুলো আইপিপি বা কুইক রেন্টাল রয়েছে, সেগুলোর হয় চুক্তির মেয়াদ শেষ অথবা ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের অপ্রাপ্যতা এবং পর্যাপ্ত গ্যাসের জোগান নেই। গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে আদানির দেড় হাজার মেগাওয়াটের জায়গায় আসছে এক হাজার মেগাওয়াট। এছাড়া ভারতের অন্য কেন্দ্রগুলোর থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াটের জায়গায় আসছে ৯০০ মেগাওয়াটের মতো।

সূত্র জানায়, বর্তমানে ২১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় বন্ধ রয়েছে। এছাড়া ইঞ্জিনের সমস্যাজনিত কারণে ২২টি কেন্দ্র আংশিক বন্ধ রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ রয়েছে আটটি কেন্দ্র। গ্যাস সংকটে ২৩টি কেন্দ্র থেকে পুরোপুরি বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না, যার মধ্যে ৯টি আংশিক ও ১৪টি পুরোপুরি বন্ধ। আর জ্বালানি তেল সংকটের কারণে ২২টি কেন্দ্র বন্ধ, যার মধ্যে ২০টি আংশিক ও দুটি সম্পূর্ণ বন্ধ। এর বাইরেও বিভিন্ন কারণে আরও ছয়টি কেন্দ্র বন্ধ। পিডিবি বলছে, গতকাল রাত ৯টায় সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ১৪ হাজার ৬৮১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যেতে পারে। এতে রাত ৯টায় লোডশেডিং হতে পারে দেড় হাজার মেগাওয়াটের মতো। তবে স্বাভাবিকভাবে রাত ১০টা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস করতে থাকে পিডিবি। যদিও রাত ১২টা পর্যন্ত চাহিদা অনেক বেশি থাকে। এতে ১০টা থেকে পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা লোডশেডিং বৃদ্ধি পায়।

প্রসঙ্গত, দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়। কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল গত ২৭ মে থেকে বন্ধ। এতে এলএনজি সরবরাহ দাঁড়িয়েছে দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট।
সার্বিকভাবে দিনে এখন গ্যাস সরবরাহ নেমে এসেছে ২৬০ কোটি ঘনফুটে। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমে দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটি ঘনফুট। আড়াই মাস আগেও গ্যাস থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হতো। এখন হচ্ছে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। ফলে সারাদিনই লোডশেডিং হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে দিনে ১০-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে।