ইসমাইল আলী:বিদায়ী অর্থবছরের শুরু থেকে ঘোষণা দিয়ে শুরু করা হয় আনুষ্ঠানিক লোডশেডিং। জ্বালানি সংকট ও তহবিল ঘাটতির কারণে এ সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে প্রায় সব খাতেই। শুধু আদানির কেন্দ্রটি চালুর পর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বেড়েছে। তবে তা সার্বিক চাহিদা পূরণ করতে পারেনি। এতে বছরজুড়েই ছিল বিদ্যুৎ ঘাটতি। এমনকি পৌষের শীতেও লোডশেডিং দেয়া হয়।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, সাময়িক হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে প্রায় সাড়ে তিন শতাংশ। তবে জ্বালানি ব্যয় ও ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়েছে এ সময়। ফলে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় গড়ে বেড়েছে প্রায় ২৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
সূত্রমতে, ২০২১-২২ অর্থবছর দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের (আমদানিসহ) পরিমাণ ছিল আট হাজার ৩৯৩ কোটি ৩৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। তবে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে আট হাজার ১০১ কোটি ১৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ উৎপাদন কমেছে ২৯২ কোটি ১৪ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বা তিন দশমিক ৪৮ শতাংশ। আর গত অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়ে ১১ টাকা আট পয়সা। তার আগের অর্থবছর যা ছিল আট টাকা ৮৪ পয়সা। অর্থাৎ গড় ব্যয় বেড়েছে দুই টাকা ২৪ পয়সা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছিল এক হাজার ৫৯৬ কোটি ৪১ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। গত অর্থবছর যা কমে দাঁড়ায় এক হাজার ২৭৭ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ পিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমেছে ২০ শতাংশের বেশি। সরকারি অন্য কেন্দ্রগুলোয় ২০২১-২২ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছিল এক হাজার ৪৭৮ কোটি পাঁচ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। গত অর্থবছর যা কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৪৫৬ কোটি ২৮ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ খাতে উৎপাদন কমেছে প্রায় দেড় শতাংশ।
বেসরকারি খাতের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় তথা ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে চার হাজার ২৯ কোটি ৯৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। ২০২১-২২ অর্থবছর যা ছিল চার হাজার ২৬১ কোটি চার লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ আইপিপিগুলোর উৎপাদন কমেছে প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাংশ। এর বিপরীত চিত্র দেখা গেছে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোয়। এ খাতে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ২৮৯ কোটি ১৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। ২০২১-২২ অর্থবছর যা ছিল ২৮৬ কোটি ৬৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ রেন্টাল কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন প্রায় এক শতাংশ উৎপাদন বেড়েছে।
এদিকে ভারত থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছিল ৭৭১ কোটি ২১ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। আদানির বিদ্যুৎ যুক্ত হওয়ায় বিদায়ী অর্থবছর আমদানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫০ কোটি ৭৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা।
অর্থাৎ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বেড়েছে প্রায় ৩৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। যদিও আমদানির পাশাপাশি ভারত থেকে বিদ্যুৎ কেনার ব্যয়ও বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির গড় ব্যয় ছিল ছয় টাকা ছয় পয়সা। গত অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট টাকা ৭৪ পয়সা। অর্থাৎ গড় ব্যয় বেড়েছে ৪৪ দশমিক ২২ শতাংশ। আদানির বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় ভারতের অন্যান্য কেন্দ্রের চেয়ে বেশি হওয়ায় এ খাতে ব্যয় এতটা বেড়েছে।
যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছর উৎপাদন ব্যয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সরকারি কেন্দ্রগুলোয়। এ খাতে ২০২১-২২ অর্থবছর গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ৪ টাকা ৭৫ পয়সা। গত অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ টাকা ৯৬ পয়সা। অর্থাৎ গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৪৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ। মূলত ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় গড় ব্যয় বাড়ায় এ খাতে এতটা ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
এদিকে পিডিবির নিজস্ব কেন্দ্রগুলোয় গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ২৬ শতাংশের বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবির কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল পাঁচ টাকা দুই পয়সা। গত অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় টাকা ৩৩ পয়সা। আর বেসরকারি খাতের বড় কেন্দ্র তথা আইপিপিগুলোয় গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ২৬ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছর এ কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল ১১ টাকা ৫৫ পয়সা। গত অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ টাকা ৬১ পয়সা।
অন্যদিকে রেন্টাল কেন্দ্রগুলোয় গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছর এ কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল ৯ টাকা ৭৩ পয়সা। গত অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ টাকা ছয় পয়সা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যাপ্ত গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে না পারায় অনেক কেন্দ্র বসে ছিল। কিন্তু বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। এতে সরকারি ও বেসরকারি সব খাতেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় বেড়ে গেছে। পাশাপাশি জ্বালানি ব্যয় বিশেষত ফার্নেস অয়েল ও কয়লার দাম গত অর্থবছরের শুরুর দিকে বেশি ছিল। এছাড়া সরকার গ্যাসের দাম ফেব্রুয়ারিতে বাড়িয়েছে। এতে জ্বালানি ব্যয়ও বেড়ে গেছে। সব মিলিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়েছে।
