ইসমাইল আলী: আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকায় কমিয়ে দেয়া হয়েছে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি। ফলে বসিয়ে রাখা হয়েছে তিন হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে চাহিদা মেটাতে তেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকটা বাড়াতে হয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে চলেছে।
দেশেও বাড়ানো হয়েছে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের দাম। পাশাপাশি কয়লার মূল্যও বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে বড় ধরনের ঘাটতিতে পড়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
চলতি অর্থবছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় সাত শতাংশ। তবে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। আগামী অর্থবছর তা আরও বাড়বে বলে শঙ্কা করছে পিডিবি। সংস্থাটির হিসাবে, শেষ হতে যাওয়া অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রায় ৪৩ শতাংশ। তবে এ খাতে সরকার ভর্তুকি দেয়া বন্ধ রেখেছে। পাশাপাশি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
পিডিবির তথ্যমতে, গত অর্থবছর পিডিবির আওতায় মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের (উৎপাদন ও আমদানি) পরিমাণ ছিল সাত হাজার ৮৫৩ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় ছিল ২৪ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। আর স্থায়ী ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হয় ২৪ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। স্থায়ী ব্যয়ের মধ্যে ছিল সরকারি কেন্দ্রগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং অন্যান্য ব্যয় আর বেসরকারি খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ।
সব মিলিয়ে গত অর্থবছর পিডিবির মোট উৎপাদন ব্যয় পড়ে ৪৯ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। এর সঙ্গে তিন শতাংশ ট্রান্সমিশন ব্যয় যোগ হবে। এতে গড় সরবরাহ ব্যয় পড়ে ছয় টাকা ৪৯ পয়সা। এ বিদ্যুতের গড় বিক্রি মূল্য ছিল পাঁচ টাকা ১২ পয়সা। এতে বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির আয় হয় ৩৮ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা। ফলে পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় ১০ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। প্রতি ইউনিটে লোকসান ছিল এক টাকা ৩৭ পয়সা।
এদিকে চলতি অর্থবছর পিডিবির আওতায় মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের (উৎপাদন ও আমদানি) পরিমাণ দাঁড়াবে আট হাজার ৩৮৯ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। তবে গ্যাস সংকট ও তেলের ব্যবহার বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় পড়ছে ৪০ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। পাশাপাশি স্থায়ী ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ২৯ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছর পিডিবির মোট উৎপাদন ব্যয় পড়বে ৭০ হাজার ৫২২ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রায় ছয় দশমিক ৮৩ শতাংশ। তবে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে ৪২ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
উৎপাদন ব্যয়ের সাথে তিন শতাংশ ট্রান্সমিশন ব্যয় যোগ হবে। এতে চলতি অর্থবছর গড় সরবরাহ ব্যয় পড়ছে আট টাকা ৬৭ পয়সা। আর চলতি অর্থবছর বিদ্যুতের গড় বিক্রি মূল্য কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ছিল পাঁচ টাকা আট পয়সা। এতে বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির আয় দাঁড়াবে ৪১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। ফলে পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় ২৯ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। প্রতি ইউনিটে লোকসান দাঁড়াবে তিন টাকা ৫৯ পয়সা।
সূত্র জানায়, গত অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে সরকার ভর্তুকি দেয় আট হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছর ডিসেম্বর পর্যন্তই ছয় মাসে ভর্তুকি দেয়া হয় ১০ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা। তবে ঘাটতি ক্রমেই বাড়তে থাকায় ভর্তুকি দেয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে গত মাসে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বাল্ক মূল্যহার প্রায় ৬৯ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করে পিডিবি। তবে কারিগরি কমিটি ৫৮ শতাংশ দাম বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে।
গত নভেম্বরে দেশে ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়। এতে প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য পড়ছে ৮০ টাকা। আর গত জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে ফার্নেস অয়েলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে ৭৬ শতাংশের বেশি। এতে ৪২ টাকা ফার্নেস অয়েল ৭৪ টাকায় বিক্রি করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তবে বেসরকারি খাতে ফার্নেস অয়েল আমদানিতে এর দাম পড়ছে ১১০ টাকা লিটার।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির শুনানিতে জানানো হয়, চলতি অর্থবছর ফার্নেস অয়েলের দাম ১২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে ১৬ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। আর আমদানিকৃত কয়লার দাম ১৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি করায় উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে দুই হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। একইভাবে ডিজেলের দাম ২০ শতাংশ বৃদ্ধি করায় উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে ৭১৮ কোটি টাকা।
এদিকে কয়লার ওপর সরকার পাঁচ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করেছে। এতে ব্যয় বাড়ছে ৩৩ কোটি টাকা। ফার্নেস অয়েলের ওপর সাড়ে ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এ খাতে ব্যয় বাড়ছে ছয় হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। এছাড়া বাল্ক বিদ্যুৎ বিতরণের ওপর উৎসে কর আরোপ করা হয়েছে ছয় শতাংশ। এতে অতিরিক্ত কেটে নেয়া হচ্ছে দুই হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। আর গ্যাস স্বল্পতার কারণে তরল জ্বালানির ব্যবহার বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ২৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে গেছে।
সূত্রমতে, চলতি মাসে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ওপর পোস্ট হেয়ারিং অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে পিডিবি জানায়, চলতি অর্থবছর পিডিবিকে সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ভর্তুকি দেয়া হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেয়া বন্ধ রেখেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি। ভর্তুকি বন্ধ রাখায় দ্রুত বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে ঘাটতির চাপে পিডিবিকে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দিতে হবে। দৈনিক এর পরিমাণ সাত থেকে সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াটও দাঁড়াতে পারে।