নিজস্ব প্রতিবেদক: বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে আদর্শ কৌশল অনুসরণ করা হয়নি। এতে কম দামি বিদ্যুৎ বেশি ও বেশি দামি বিদ্যুৎ কম উৎপাদন কৌশল অনুসরণ করা হয়। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে তা সমন্বয় করা হয়নি। আবার উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জের জন্য বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর নন-ফুয়েল কস্টও অনেক বেশি। ফলে এক বছরে বিদ্যুৎ খাতে জনগণের ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষতি পুরোটাই জনগণকে বহন করতে হবে।
গতকাল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) অনুষ্ঠিত বিদ্যুতের পাইকারি (বাল্ক) মূল্য কমানোর গণশুনানিতে এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। এ ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিবর্তে এক টাকা ৫৬ পয়সা দাম কমানোর প্রস্তাব করা হয়।
গণশুনানিতে ক্যাবের পক্ষে প্রস্তাবনা তুলে ধরেন সংগঠনটির জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে থাকলেও সেগুলোয় গ্যাস সরবরাহ করা হয় না। এগুলোর সর্বোচ্চ প্লান্ট ফ্যাক্টর ৩৬ শতাংশ। অথচ বেসরকারি কেন্দ্রগুলোতে নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এগুলো ৭০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে উৎপাদন করছে। আর ক্ষমতা ব্যবহার অসমতায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তিন হাজার ২৬৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও ফার্নেস অয়েলের দাম পুরোটা কমানো হয়নি। এতে ক্ষতি হচ্ছে দুই হাজার ৬৭১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
এদিকে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দেওয়া হচ্ছে উচ্চ হারে। অথচ ২০০৯ সালে বলা হয়েছিল এগুলো তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও এগুলোর মেয়াদ আবার বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে এ খাতে সরকারের অযৌক্তিক ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৭৮৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এছাড়া বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। অথচ সেচ ও লাইফ লাইন বিদ্যুতের বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর বড় ধরনের লোকসান হচ্ছে। এর পরিমাণ তিন হাজার ৬৮৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ক্ষতি হয়েছে ১১ হাজার ৪১১ কোটি টাকা।
অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, কতিপয় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সুবিধা দিতে মেয়াদ-উত্তীর্ণের পরও রেন্টাল-কুইক রেন্টালের চুক্তি নবায়ন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট কমানো হচ্ছে না। আবার বিপিসির তেলের ভেজাল অভিযোগ তুললে তাদের জ্বালানি তেল আমদানির সুযোগ দেওয়া হলো। ফার্নেস অয়েল বলে চুক্তি করেও ডিজেলে রূপান্তর করে হাজার কোটি টাকা বেশি নিয়ে যাচ্ছে সামিট। একই কোম্পানি বিএসটি-৩ বলে সামিট পল্লী বিদ্যুতের কাছ থেকে ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে গেল। অথচ চুক্তি বাতিল হলো না। এ পরিষ্কার কোরাপশন থ্রæ ডেভেলপমেন্ট বলে কিছু থাকলে তা অন্য কোনো খাত থাক বা না থাক বিদ্যুৎ খাতের জন্য শতভাগ প্রযোজ্য।
ক্ষতি সাশ্রয়ের কৌশল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ক্যাব জানায়, বেশি ব্যয়ের ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কম হলে ৭৫২ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট যৌক্তিক করা হলে সাশ্রয় হতো এক হাজার ৭৮৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। আবার সরকারি গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করা গেলে উৎপাদন ব্যয় সাশ্রয় হতো এক হাজার ৩০১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। ডিজেলের পরিবর্তে গ্যাসে মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালিত হলে আরও ব্যয় কমত এক হাজার ৩৩২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এছাড়া তেলের দাম কমানো হলো ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে দুই হাজার ১১০ কোটি ৫১ লাখ ও ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ৫৬০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা সাশ্রয় হতো।
উল্লিখিত ব্যয় সাশ্রয় করা গেলে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় পড়ত তিন টাকা ৩৪ পয়সা। অথচ বর্তমানে পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহার চার টাকা ৯০ পয়সা। অর্থাৎ এক টাকা ৫৬ পয়সা উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব।
যদিও বিদ্যুতের বাল্ক মূল্য দাম বৃদ্ধির জন্য গত মার্চে প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। গত ২৫ সেপ্টেম্বর এর ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৭২ পয়সা বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল বাবদ ২৬ পয়সা, ভর্তুকির সুদ ২১ পয়সা, পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহারে ঘাটতি পাঁচ পয়সা ও মেঘনাঘাট আইপিপিতে ফার্নেস অয়েলের পরিবর্তে ডিজেল ব্যবহারে ১৪ পয়সা বৃদ্ধি করতে হবে।
যদিও সে যুক্তি খণ্ডন করে অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, উল্লিখিত ৬৬ পয়সা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যদিকে আয়হার অন্তর্ভুক্ত করেনি পিডিবি। এক্ষেত্রে ভোক্তা পর্যায়ে ১৩২ কেভি লেভেলে বিদ্যুৎ বিক্রিতে উদ্বৃত্ত আয় আট পয়সা ও পাওয়ার ফ্যাক্টর কারেকশন চার্জ চার পয়সা। এ আয়হার অন্তর্ভুক্ত হলে বাল্ক বিদ্যুতের দাম উল্টো ছয় পয়সা উদ্বৃত্ত হয়ে যায়। সুতরাং বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কোনো প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়।
গণশুনানিতে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, একই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএম আকাশ, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকী, এফবিসিআইয়ের পরিচালক আমজাদ হোসেন প্রমুখ।