ইসমাইল আলী: আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া শুরু করে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেশিরভাগের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য। কিছু কেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয় ১৫ বছরের জন্য। যদিও তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি কেন্দ্রগুলো চলেছে ১২ থেকে ১৫ বছর ধরে। এসব কেন্দ্রের অনুমোদন থেকে নির্মাণের প্রতি ক্ষেত্রেই হয়েছে দুর্নীতি।
কয়েকটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ছিল বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি। সংশ্লিষ্টরা দুর্নীতির এ মডেলের নাম দিয়েছিলেন ‘বাংলাদেশি মডেল’। এ মডেলে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপদেষ্টা থেকে শুরু করে সচিব, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান ও সদস্যরা, মন্ত্রণালয়, পিডিবি ও পাওয়ার সেলের বিভিন্ন স্তরের অফিসার, প্রতিমন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) এবং বেশ কয়েকজন সাংবাদিক সরাসরি বা বিভিন্নভাবে সুবিধা নিয়েছেন। কেউ নগদ কমিশন নিয়েছেন, কেউবা ছোটখাটো কোনো টেন্ডার বা বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স নিয়েছেন। এছাড়া বিদেশ ট্রিপ তো ছিল নিয়মিত ঘটনা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেয়ার সময় দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল প্রকট। তাই চাহিদা পূরণে দ্রুত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য বেসরকারি খাতকে অগ্রাধিকার দেয় সরকার। মূল দুর্নীতির শুরু এখান থেকেই। এসব লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। মূলত ডেকে এনে লাইসেন্স দেয়া হয় আওয়ামী লীগ ঘরনার ব্যবসায়ীদের। এ সুযোগে সামিট, ইউনাইটেড, বাংলাক্যাট, মোহাম্মদী গ্রুপ, ডরিন, বারাকা, সিনহা, হোসাফসহ বেশকিছু কোম্পানি একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে।
যদিও এত বেশি কেন্দ্রের প্রয়োজন ছিল না বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। ফলে অনেক কেন্দ্রই নামমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন করে শত শত কোটি টাকা আয় শুরু করে। আবার আনসলিসিটেড বা অযাচিত প্রস্তাব যাচাইয়ের মাধ্যমে এসব লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। দরকষাকষির ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নির্মাণব্যয়। ফলে ক্যাপাসিটি চার্জ ধরা হয়েছিল উচ্চ হারে। যদিও বাস্তবে তা আরও অনেক কম হওয়ার কথা ছিল। পিডিবির একাধিক সাবেক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা নেয়া হয়।
তারা জানান, কোনো ধরনের স্টাডি ছাড়াই বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত। তবে পরবর্তীতে এলাকা বা জোনভেদে চাহিদার বিষয়টি পর্যালোচনা করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করা হয়। তার আগ পর্যন্ত মূলত সহজে রেল সংযোগ বা সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে এসব স্থানকেই অগ্রাধিকার দেয়া হতো। এছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন রয়েছে, এসব জায়গাকেও অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
এর বাইরে নৌবন্দর বা সহজে নৌপরিবহন ব্যবস্থা আছে, এমন জায়গাকেও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। মূলত বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি সহজে পরিবহন করে নেয়া, জ্বালানি তেল বা কয়লা সহজে বিদ্যুৎকেন্দ্রে পৌঁছানো বা গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে এসব জায়গা বিবেচনা করা হতো। আবার উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সহজে সরবরাহকেও গুরুত্ব দেয়া হয়। তবে এটি করতে গিয়ে বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়েকটি জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদ্যুৎ খাতে মূল দুর্নীতি হয়েছিল লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে। গত দেড় দশকে অনুমোদন দেয়া প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে নির্মাণব্যয় কমপক্ষে ৩০ শতাংশ বেশি ধরা হয়। বাড়তি এ অর্থ কমিশন আকারে ভাগ-বাটোয়ারা হতো বিভিন্ন স্তরে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী-চৌধুরী সরাসরি কমিশন নিতেন।
এছাড়া বিদ্যুৎ সচিব, পিডিবির চেয়ারম্যান ও সদস্যরাও প্রতিটি সাইনের বিনিময়ে অর্থ নিতেন। ফাইল চলাচলের জন্য প্রতিটি ডেস্কে অর্থ খরচ করতে হতো। আবার সাইনের পর সংশ্লিষ্টদের সিল নিতে গেলে একেবারে নিচের দিকের অফিসার বা পিওন পর্যন্ত চা-পানির খরচের কথা বলে অর্থ চেয়ে নিতেন। প্রতিটি খাতে বাড়তি ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করা হতো বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণব্যয়ের মাঝে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, লাইসেন্স নেয়ার পর বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেশিনারি তথা যন্ত্রপাতি কেনাতেও চুরি তথা লুটপাট হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়ার সময় মেশিনারির যেসব ক্রাইটেরিয়া বা মান বেঁধে দেয়া হয়েছিল, তা তৈরি করে বিশ্বের হাতে গোনা চার থেকে পাঁচটি কোম্পানি। এর মধ্যে অন্যতম যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিক, ফিনল্যান্ডের ওয়ার্টসিলা, নরওয়ের রোলস রয়েস, জার্মানির এমএএন ও সিমেন্স। কিন্তু বাংলাদেশে প্রায় সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেশিন আনা হয়েছে দুবাইয়ের সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেট থেকে। কিছু আনা হয়েছে সিঙ্গাপুরের সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেট থেকেও। এসব মেশিনে লেখা নেই কোন দেশে তৈরি বা ম্যানুফ্যাকচার্ড। ধারণা করা হয় এগুলো চীনের তৈরি। আর এভাবে অর্ধেক বা তারও কম দামে যন্ত্রপাতি কিনে অর্থ পাচার করা হয়েছে। বাংলাক্যাটের ক্ষেত্রে এর প্রমাণ পায় বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তাদের পরিচালিত বিশেষ এক পরিদর্শনে অর্থ পাচারের এ তথ্য উঠে আসে ২০২০ সালে।
সংস্থাটি জানায়, সরকারের সঙ্গে চুক্তি ছিল কোম্পানিটি নতুন বা ভাড়ায় আনা যন্ত্রপাতি দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে। অথচ তারা কম দামে আমদানি করে পুরোনো যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্রপাতি দুবাই ও সিঙ্গাপুরের দুই প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা হয়, যার মালিক বাংলাক্যাটের মালিকের এক ছেলে। এভাবেই অর্থ পাচার করেছে বাংলাক্যাট। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) প্রতিবেদনটি পাঠায় বিএফআইইউ। তবে পরবর্তীতে তা আর এগোয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদ্যুৎ খাতের প্রতিটি বিষয় অনুমোদনের জন্য প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিদ্যুৎমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। আর নসরুল হামিদের ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করতেন তার পিআরও মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন। প্রতিমন্ত্রীর পাশাপাশি অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন বিসিএস ২০ ব্যাচের তথ্য ক্যাডারের এ কর্মকর্তা। অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রায় অর্ধশতবার সফর করেছেন বিদেশে।
এদিকে বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির এসব ঘটনা ধাপাচাপা দিতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে হাতে রেখেছিলেন নসরুল হামিদ। তাদের বিনা খরচে নিয়মিত বিদেশি ট্রিপের ব্যবস্থা করে দিতেন প্রতিমন্ত্রী নিজেই। নগদ অর্থ ও নিয়মিত উপঢৌকনও দেয়া হতো। দুই সাংবাদিক পেয়েছেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স। এছাড়া কয়লা সরবরাহ, ডকুমেন্টারি নির্মাণসহ নানা কাজের ঠিকাদারি দিয়ে সন্তুষ্ট রাখা হতো সাংবাদিকদের।
এসব দুর্নীতির বিষয়ে পিডিবির সাবেক কোনো চেয়ারম্যান বা সদস্যই মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিগত সরকারের সময়ে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে।
এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের অর্থ লোপাট হয়েছে। এসবের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। এজন্য একজন বিচারপতিকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।