ইসমাইল আলী: বিদ্যুৎ খাতে কয়েক বছর ধরে ভর্তুকির চাহিদা বাড়ছে। তবে সে অনুপাতে অর্থ ছাড় করছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) পড়েছে বিপাকে। বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিশেষত বেসরকারি খাতের বিল পরিশোধ করতে পারছে না সংস্থাটি। ফলে জ্বালানি আমদানি ব্যাহত হওয়ায় অনেক বেসরকারি কেন্দ্র চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না। এতে চাহিদা কিছুটা বাড়লেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে লোডশেডিং।
পিডিবির তথ্যমতে, চলতি অর্থবছর শেষে বকেয়া ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। যদিও ২০১৯-২০ অর্থবছর এ বকেয়ার পরিমাণ ছিল মাত্র এক হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ চার বছরের ব্যবধানে বকেয়া ভর্তুকির পরিমাণ ৩৪ গুণ বেড়ে গেছে। এছাড়া চলতি অর্থবছর জানুয়ারি পর্যন্ত ছাড় করা ভর্তুকির বড় অংশই ছিল বন্ডে। তবে এ বন্ড ভর্তুকি থেকে সাময়িক মুক্তি দিলেও সরকারের দায় বাড়াচ্ছে।
যদিও বাজেট সংকট ও অন্যান্য খাতে বরাদ্দের কারণে বিদ্যুৎ খাতকে চাহিদা অনুযায়ী ভর্তুকি দিতে পারছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিডিবির ভর্তুকি ঊর্ধ্বমুখী চিত্র গত কয়েক বছর ধরে বাজেটে বড় ধরনের চাপ তৈরি করছে। ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত তিন অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটির ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়িয়েছে এক লাখ আট হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা। ভর্তুকির এ পরিমাণ পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও টানেলের সম্মিলিত নির্মাণব্যয়ের চেয়েও বেশি। তাই শুধু বিদ্যুৎ খাতকে এত অর্থ বরাদ্দ দেয়া যাচ্ছে না।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাহিদা ছিল পাঁচ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর পিডিবি বরাদ্দ পায় চার হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। ফলে অর্থবছর শেষে ৯৮০ কোটি টাকা ভর্তুকি বকেয়া রয়ে যায়। পরের অর্থবছর পিডিবির লোকসান আরও বাড়ায় ভর্তুকি চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে আগের অর্থবছরের বকেয়া যোগ করে মোট ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়ায় আট হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দেয় সাত হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। এতে ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে ভর্তুকি বকেয়া রয়ে যায় ৫১৪ কোটি টাকা।
২০১৯-২০ অর্থবছর পিডিবির ভর্তুকি চাহিদা আরও কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় সাত হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা। এর সঙ্গে আগের অর্থবছরের বকেয়া যোগ করে মোট ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়ায় আট হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দেয় সাত হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। এতে অর্থবছর শেষে ভর্তুকি বকেয়া বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ২১ কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছর পিডিবির লোকসান অনেকখানি বৃদ্ধি পায়। এতে ভর্তুকি চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। এর সঙ্গে আগের অর্থবছরের বকেয়া যোগ করে মোট ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়ায় ১২ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দেয় মাত্র আট হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর শেষে ভর্তুকি বকেয়া এক লাফে সাড়ে তিনগুণ হয়ে যায়। অর্থাৎ বকেয়া ভর্তুকি বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবির লোকসান এক লাফে আড়াইগুণ হয়ে যায়। এতে ওই অর্থবছর পিডিবি ভর্তুকি চায় ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এর সঙ্গে আগের অর্থবছরের বকেয়া যোগ করে মোট ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দেয় মাত্র ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর শেষে ভর্তুকি বকেয়া প্রায় ছয়গুণ বৃদ্ধি পায়। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে বিদ্যুৎ খাতে বকেয়া ভর্তুকি বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা।
গত অর্থবছর পিডিবির লোকসান আরও বাড়ে। এতে ভর্তুকি চাওয়া হয় ৩৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। এর সঙ্গে আগের অর্থবছরের বকেয়া যোগ করে মোট ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়ায় ৬০ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দেয় মাত্র ২৯ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ভর্তুকি বকেয়া দাঁড়ায় ৩০ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা।
এদিকে চলতি অর্থবছরও পিডিবির লোকসান গত অর্থবছরের মতোই থাকবে বলে প্রাক্কলন করেছে সংস্থাটি। এতে ভর্তুকি লাগবে ৩৯ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এর সঙ্গে গত অর্থবছরের বকেয়া যোগ করে মোট ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ রেখেছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এতে ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে বিদ্যুৎ খাতে বকেয়া ভর্তুকি থেকে যাবে ৩৫ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছর জানুয়ারি পর্যন্ত ভর্তুকি বাবদ পিডিবিকে দেয়া হয়েছে ২৫ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে পিডিবি নগদ ভর্তুকি পেয়েছে ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর বন্ডে দেয়া হয়েছে ১৬ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দকৃত ভর্তুকির মধ্যে ৯ হাজার ৪০২ কোটি টাকা ছাড় হওয়া বাকি আছে। তবে এ অর্থ দিয়ে চাহিদার খুব সামান্যই মেটানো যাবে।
পিডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শেয়ার বিজকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় চাহিদা অনুযায়ী ভর্তুকি ছাড় না করায় পিডিবিকে বিল পরিশোধে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছর ভর্তুকি বকেয়া ছিল তিন হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এতে ওই অর্থবছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বিল পরিশোধে বিলম্ব হয়। পরের অর্থবছরের ভর্তুকি দিয়ে ওই বকেয়া পরিশোধ করতে হয়। এতে পরের অর্থবছর বকেয়া বেড়ে যায়।
যদিও সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে গত অর্থবছরের বকেয়া নিয়ে। ২০২১-২২ অর্থবছর ২০ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা ভর্তুকি বকেয়া পড়ায় সেপ্টেম্বর’২১ থেকে জুন’২২ পর্যন্ত ১০ মাসের বিল বকেয়া ছিল, যা ২০২২-২৩ অর্থবছর শোধ করতে হয়েছে। আবার ২০২২-২৩ অর্থবছর ৩০ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা ভর্তুকি বকেয়া থাকায় আগস্ট’২২ থেকে জুন’২৩ পর্যন্ত বিল বকেয়া পড়ে যায়; যা চলতি অর্থবছর কিছু বন্ডে ও কিছু নগদ ভর্তুকি দিয়ে শোধ করতে হয়েছে। এতে আগস্ট’২২ থেকে এপ্রিল’২২ পর্যন্ত বকেয়া শোধ করা গেছে। তবে এখনও মে ও জুনের বকেয়া রয়ে গেছে।
এদিকে গত অর্থবছরের মে ও জুনের বকেয়ার পাশাপাশি চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত পুরো বিলই বকেয়া পড়েছে। এ বকেয়া কীভাবে পরিশোধ করা যাবে তা নিয়ে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছে পিডিবি।