ইসমাইল আলী: গ্যাসের স্বল্পতায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে তরল জ্বালানির ব্যবহার গত বছর নভেম্বর থেকে বাড়ছে। এতে বিদ্যুৎ খাতে লোকসান অনেক বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরের তিন মাসেই (মার্চ-মে) লোকসান হয়েছে চার হাজার কোটি টাকার বেশি। এজন্য গত মাসে ভর্তুকি চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। তবে বিদ্যুৎ খাতে লোকসান অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
গত ৬ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে (পিডিবি) এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয় পিডিবি। এতে তিন মাসে পিডিবির চার হাজার চার কোটি ৪৩ লাখ টাকা লোকসানের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। পাশাপাশি লোকসান বেড়ে যাওয়ার কারণ, ভর্তুকির ব্যবহার, এক দশকে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রভাব ইত্যাদি বিষয় জানতে চাওয়া হয়।
চিঠির জবাবে পিডিবি জানায়, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পরবর্তী সময়ে বিদ্যুৎ খাতে আইপিপি (বেসরকারি) খাতে ছয় হাজার ৩১৩ মেগাওয়াট ক্ষমতা সংযোজিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গ্যাসের ৫৭৬ মেগাওয়াট, তরল জ্বালানিভিত্তিক চার হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট (তিন হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েল ও এক হাজার মেগাওয়াট ডিজেল), কয়লাভিত্তিক এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ও সোলার ১১৩ মেগাওয়াট। এতে বর্তমানে বেসরকারি খাতে আইপিপি ও রেন্টাল মিলিয়ে খাতে ছয় হাজার ২৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, যার বড় অংশই আমদানিকৃত ফার্নেস অয়েলভিত্তিক।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ফার্নেস অয়েলের দাম বেড়ে প্রতি মেট্রিক টন ৫৩০-৫৫০ ডলার হয়েছে, যা ২০২০ সালে মে মাসে ছিল ৩৪০-৩৬০ ডলার। আর ২০২০ সালের জুনে ফার্নেস অয়েল আমদানিতে শুল্ক-কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করায় এ খাতে ব্যয় ৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার পরিমাণ বছরে ৩৫০-৪০০ কোটি টাকা। যদিও জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম স্থিতিশীল থাকায় এ খাতে ব্যয় তেমন বাড়েনি। তবে নভেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ক্রমেই বাড়তে থাকে। এর প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ে।
পিডিবি আরও জানায়, গ্যাসভিত্তিক আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় ২০২০ সালে মে মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬৮ শতাংশ আর তরল জ্বালানিভিত্তিক ছিল ৩২ শতাংশ। তবে গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পাওয়ায় চলতি বছর মে মাসে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদনের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশ, তরল জ্বালানিভিত্তিক ৪৫ শতাংশ, কয়লাভিত্তিক ১১ শতাংশ ও সোলার এক শতাংশ। এতে গত বছরের মে মাসের তুলনায় চলতি বছর মে মাসে ঘাটতি বেড়েছে ৫৭ শতাংশ।
এদিকে বাংলাদেশ ও চীন যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত পায়রা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে এলেও সঞ্চালন লাইনের সীমাবদ্ধতায় পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কিন্তু ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হচ্ছে। এতে বছরে ঘাটতি হচ্ছে ১৭০-১৮০ কোটি টাকা। আর বিইআরসি কর্তৃক সর্বশেষ প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের বিক্রয়মূল্য ৫ টাকা ১৭ পয়সা নির্ধারণ করলেও বর্তমানে তা কমে পাঁচ টাকা ১১ পয়সা হয়েছে। সব মিলিয়ে ঘাটতি বেড়েছে।
এক দশকের বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বলা হয়, উৎপাদন ব্যয় অপেক্ষা বিক্রয়মূল্য কম থাকায় বিদ্যুতের ট্যারিফ বৃদ্ধিতে পিডিবি বিভিন্ন সময়ে বিইআরসিতে মূল্য সমন্বয়ের প্রস্তাব পাঠায়। এতে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত আট দফায় বিদ্যুতের গড় বাল্ক বিক্রয়মূল্য দুই টাকা ৩৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে পাঁচ টাকা ১৭ পয়সা করা হয়েছে। তবে দাম বৃদ্ধির পরও পিডিবির বড় ধরনের লোকসান হচ্ছে।
এ অবস্থায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখার স্বার্থে ফেব্রুয়ারির আংশিক ও মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সময়ের জন্য চার হাজার ১৫১ কোটি ছয় লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা চাওয়া হয়।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. বেলায়েত হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, গ্যাসের সরবরাহ কমায় তরল জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামও অনেক বেড়ে গেছে। আবার ফার্নেস অয়েল আমদানির শুল্ক-কর অব্যাহতি তুলে দেয়ায় এ ব্যয়ও বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। ফলে লোকসান বেড়ে গেছে। এজন্য ভর্তুকিও বেশি প্রয়োজন পড়ছে।
উল্লেখ্য, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাস ও ফেব্রুয়ারির জন্য আংশিক ভর্তুকি ছাড় করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। এর পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৩৫২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। তবে ফেব্রুয়ারির বাকি সময়ের জন্য আরও ১৪৬ কোটি টাকা ভর্তুকি দরকার। আর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তিন মাসে আরও চার হাজার চার কোটি ৪৩ লাখ টাকা ভর্তুকি দরকার। সব মিলিয়ে চার হাজার ১৫১ কোটি ছয় লাখ টাকা চাওয়া হয়।
এদিকে জুনের হিসাব চূড়ান্ত না হওয়ায় ভর্তুকি এখনও চাওয়া হয়নি। তবে জুনেও প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এতে গত অর্থবছর ঘাটতি তথা ভর্তুকি ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।