Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 5:52 pm

বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে নেই সুখবর ধেয়ে আসছে খাদ্য সংকট

নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, আগামী বছরের মধ্যে বিশ্ব খাদ্য সংকটের জন্য দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আর এ সংকটের শিকার হবে ৪৫টি দেশ। যে দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের নামও রয়েছে। এমনকি আগামী দিনে কোনো দেশের হাতে পর্যাপ্ত ডলার থাকলেও কেনার জন্য খাদ্য পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নানা পরিস্থিতি ও দেশীয় নানা নীতির ক্ষেত্রে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে চরম সংকটাপন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চলেছে দেশ। এমনকি চলমান লোডশেডিং ও জ্বালানি সংকট কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে, সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গতকাল তাদের কার্যালয়ে ‘বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আভাস: বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ, উত্তরণ কোন পথে?’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানায়। সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খানসহ অন্যান্য গবেষক। সংবাদ সম্মেলনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করা হয়। এগুলো হলো মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য মূল্যে অস্থিরতা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং অর্থনীতির বহিঃখাতের চ্যালেঞ্জ।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, এফএওর প্রক্ষেপণ বলছে, বিশ্ব ভয়াবহ খাদ্য সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনকি টাকা দিয়েও খাদ্য না পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগে থেকেই দেশে খাদ্যের মজুত বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়া অভ্যন্তরীণ উৎপাদন শাক্তিশালী করার পাশাপাশি সরবরাহ শৃঙ্খল সচল রাখার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

তিনি উল্লেখ করেন, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়

অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে চার সদস্যের কোনো পরিবার যদি মাছ-মাংস না খেয়ে দিনাতিপাত করে, তাহলেও মাসে কেবল তাদের খাবারের পেছনে ব্যয় হবে ৯ হাজার টাকা। আর স্বাভাবিক নিয়মে মাছ-মাংস গ্রহণ করলে চার সদস্যের মাসিক খাদ্য খরচ আসবে সাড়ে ২২ হাজার টাকার মতো। নি¤œ আয়ের পরিবারগুলোর পক্ষে এ ব্যয় বহন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও তাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় নানা কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে।

এর বাইরে চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসে স্বাস্থ্যসেবা বাবদ ব্যয় হয় ২ হাজার ৬২৫ টাকা। আসন্ন খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সরকারের গুদামজাতকরণ সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেয় সিপিডি। পাশাপাশি খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকারি সহায়তার পরিমাণ বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়।

জ্বলানি ও বিদ্যুৎ খাতের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়, চলমান জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলার কোনো উপায় নেই। আর গত চার অক্টোবরের পর থেকে যে হারে লোডশেডিং হচ্ছে, তাতে শিল্প উৎপাদন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে কেবল বাংলাদেশেই নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনায় অন্যান্য দেশেও জ্বালানি ও বিদ্যুতের সংকট বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে একটি দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নীতির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে সিপিডি।

দেশে বর্তমানে জ্বালানির যে মজুত রয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয় উল্লেখ করে জানানো হয়, যে কোনো জ্বালানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬০ দিনের মজুত থাকতে হয়। কিন্তু বর্তমানে দেশে জ্বালানির মজুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, একমাত্র ডিজেলের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। বাকি জ্বালানিগুলোর ক্ষেত্রে মজুতে ব্যাপক ঘাটতি বিদ্যমান। অকটেনের ক্ষেত্রে মাত্র সাড়ে ১৯ দিনের মজুত রয়েছে। পেট্রোলের যে মজুত রয়েছে তা দিয়ে ৩৮ দিন চলবে। আর ফার্নেস অয়েলের মজুত দিয়ে ৩৮ দিন চালানো সম্ভব। এ তিনটি জ্বালানির ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি বিদ্যমান। এ ঘাটতি মোকাবিলায় মজুত বাড়ানোর ওপর জোর দেয় সিপিডি। এছাড়া দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনের সঠিক হিসাব প্রকাশের তাগিদ দিয়েছে সিপিডি।

অর্থনীতির বহিঃখাতের মূল্যায়নে সিপিডি উল্লেখ করে, রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এছাড়া যে আমদানি ব্যয় মেটানো হচ্ছে, তাতে দেখা যায় ভোগ্যপণ্য ও মধ্যবর্তী কাঁচামালের আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়েছে। তবে খাদ্য আমদানি ও মূলধনি যন্ত্রাংশ আমদানি ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে। মূল যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি উদ্বেগের বিষয় বলে মনে করে সিপিডি।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুতগতিতে হ্রাস পাচ্ছেÑউল্লেখ করে ফাহমিদা খাতুন জানান, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার। কয়েক মাসের ব্যবধানে গত ১২ অক্টোবর তা নেমে আসে ৩৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে। এভাবে চলতে থাকলে আমদানি ব্যয় মেটানো কঠিন হয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে আইএমএফ থেকে প্রতিশ্রুত ঋণ পেলে রিজার্ভ কিছুটা শক্তিশালী হবে বলে জানায় সিপিডি। তবে আইএমএফ থেকে ঋণ পেতে হলে বেশকিছু শর্ত পূরণ করতে হবে বলেও স্মরণ করিয়ে দেয় সংস্থাটি।

বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে সাদ ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে জানায় সিপিডি। এর মধ্যে প্রধান চারটি সংকট হলোÑডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য সংকট। আর এ সংকটগুলোকে ঘনীভূত করেছে আরও তিনটি সংকট। এগুলো হলোÑজলবায়ু পরিবর্তন, কভিড-১৯ সংকট ও ইউক্রেন সংকট। এ সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক-কর হ্রাস করার পরামর্শ দেয় সিপিডি। এছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা উচিত বলে মনে করে সিপিডি।

আলোচনায় অংশ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার বেসরকারি খাতে চাল আমদানির অনুমোদন দিলেও ডলারের বাজারে অস্থিরতার কারণে আমদানিকারকরা লোকসানের শঙ্কায় চাল আমদানি করছেন না। তার মানে এই নয় যে, দেশে খাদ্যের উদ্বৃত্ত মজুত রয়েছে। এক্ষেত্রে ডলার বিনিময় হারে শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, আগামী দিনে বিশ্বে ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দেবে। এমনকি আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলার হাতে থাকলেও হয়তো খাদ্য পাওয়া যাবে না।

বিদ্যুৎ খাতে সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, পিডিবি বর্তমানে তার দায়দেনা পরিশোধ করতে পারছে না অর্থাভাবে। এ দায়দেনার বড় অংশ হচ্ছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ। ত্রুটিপূর্ণ চুক্তির কারণে সরকারকে বছরের পর বছর ধরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এমনকি এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। এসব ত্রুটিপূর্ণ চুক্তি সংশোধন করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ না করলে কোনো বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হবে না এমন বিধান যুক্ত করতে হবে চুক্তিতে।