নিজস্ব প্রতিবেদক: বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইন বাতিল চায় ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটি বলছে, এটি একটি ‘দায়মুক্তি আইন’। এ আইনের আওতায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকার যা খুশি, তা-ই করতে পারবে। দরপত্র ছাড়াই যেকোনো চুক্তি করতে পারবে। সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতেও যাওয়া যাবে না। অপরাধ করলে বিচার করা যাবে না, এটা কোনো সভ্য সমাজে চলতে পারে না।
‘জ্বালানিসংকট ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন’ শীর্ষক এক সেমিনারে গতকাল শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এসব কথা বলেছে ক্যাব। এতে জ্বালানি খাতের সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরে ১৩ দফা দাবি জানানো হয়। এ দাবির শুরুতেই প্রতিযোগিতাহীন যেকোনো আইন নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়। দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার কথা জানান রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, শুধু ঋণ নয়, বিদেশি অনুদানেরও বিভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে। বিএনপি সরকারের সময় খাম্বা ছিল, বিদ্যুৎ ছিল না। আর এখন বিদ্যুৎ আছে, খাম্বা (সরবরাহের সক্ষমতা) নেই। রাষ্ট্রক্ষমতা পুরোপুরিভাবে সামরিক-বেসামরিক আমলাদের হাতে চলে গেছে।
জ্বালানি খাতকে আমদানিনির্ভর করা হয়েছেÑউল্লেখ করে মেনন বলেন, আমরা এলএনজি আমদানি করছি। পাশাপাশি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) যে রিজার্ভ গ্যাস রয়েছে; সেগুলো উত্তোলন না করে আমরা আমদানি জ্বালানিতে নির্ভর করছি। এ বিষয়ে আমি সংসদে অনেক ডিবেট করেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সংসদের এসব ডিবেট গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় না। তবে আমরা যখনই কোনো ‘চুটকি’ বলি সংসদে তা খুব বড় করে প্রচার হয়। সর্বোপরি এটাই বলতে চাই, এলএনজি আমদানির ফলে দামের যে দায়ভার তা জনগণের ওপর পড়ছে।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি আরও বলেন, এখন বিদ্যুতের উৎপাদন হচ্ছে, কিন্তু ব্যবহার করতে পারছি না। বসে থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। ইনডেমনিটি একটি ঘৃণিত শব্দ আমাদের রাজনীতিতে। অথচ ২০২২ সালে এসে আবার সংশোধিত করে নবায়ন করা হয়েছে। এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে, এলএনজি লবি অনেক ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে। লুণ্ঠনবৃত্তি বিগত সরকারের মতো অব্যাহত রয়েছে। আমাদের সংসদ যে ভূমিকা পালন করার কথা, দুঃখজনক হলেও সত্য সংসদ সঠিকভাবে ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ও সিনিয়র সহসভাপতি ড. শামসুল আলম বলেন, উইন্ড ম্যাপিং অনুযায়ী বাংলাদেশে বায়ু বিদ্যুতের উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ৩০ হাজার মেগাওয়াট। ভারতে এখন বায়ু ও সৌর বিদ্যুতের মূল্যহার কমবেশি ৩ রুপি। ভারত তার পরিকল্পনায় বলছে ২০৩০ সাল নাগাদ সৌর বিদ্যুতের মূল্যহার ১ দশমিক ৯ থেকে ২ দশমিক ৬ রুপিতে নেমে আসবে। আর বায়ু বিদ্যুৎ ২ দশমিক ৩ থেকে ২ দশমিক ৬ রুপিতে পাওয়া যাবে। সেখানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ২০২২-২৩ অর্থবছরে সৌর বিদ্যুৎ ৯ দশমিক ৯৯ টাকা আর বায়ু বিদ্যুতের চুক্তি করেছে ১৩ দশমিক ২০ টাকায়। কারিগরি সক্ষমতার উন্নয়ন ও বিনিয়োগ ব্যয়ের ন্যায্যতা নিশ্চিত হলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দাম ভারতের মতো হতো।
গ্যাস বণ্টনে বৈষম্য থাকায় ১ টাকার গ্যাস ৮৩ টাকায় কেনা হচ্ছে উল্লেখ করে ড. শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুতের কমবেশি ৭ শতাংশ হারে সরবরাহ বৃদ্ধি হলেও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে ১২ শতাংশ। জ্বালানির অভাবে বিদ্যুতের উৎপাদন কম হচ্ছে। এতে করে ভোক্তারা অসহনীয় মূল্য বৃদ্ধির কবলে পড়ছে। গ্যাস বণ্টনে সরকারি খাত বৈষম্যের শিকার। দেশীয় কোম্পানির কাছ থেকে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস কেনা হচ্ছে ১ দশমিক ৩ টাকায়, আর সমপরিমাণ এলএনজি আমদানিতে ব্যয় করা হচ্ছে ৮৩ টাকা। গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে গ্যাসের মজুদ ও উৎপাদন প্রবৃদ্ধি নেই বললেই চলে। অথচ তহবিলের ৬৫ শতাংশ অর্থ অব্যবহƒত রয়ে গেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরূল ইমাম বলেন, সম্প্রতি যেসব গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে সবগুলো করেছে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স। সেই প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। ইউএসজিএস তাদের এক সার্ভে রিপোর্টে বলেছে, বাংলাদেশে আরও ৩২ টিসিএফ গ্যাস অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। বর্তমানে বছরে ১ টিসিএফ গ্যাস ব্যবহƒত হচ্ছে সে হিসেবে আরও ৩২ বছরের মজুদ রয়েছে। দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম সঠিক গতিতে না হওয়ায় আজকের এ সংকট। অচলাবস্থার কারণেই চড়া দামে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, দেশীয় গ্যাস তুললে যে লাভ তার চেয়ে না তুললে বেশি লাভ। আমদানি করলে কমিশনের বিষয় থাকতে পারে। এটা শুধু আজ থেকে নয়, ঐতিহাসিকভাবেই অনুসন্ধানে স্থবিরতা বিদ্যমান। সরকার পরিবর্তন হলে একটা আশা করা হয়, কিন্তু সেভাবে পরিবর্তন হয়নি। বরং আগের ধারার সঙ্গে নতুন ধারা আমদানি যুক্ত করা হয়েছে। এই অবস্থা থাকলে ৩০ সালে গ্যাস খাত পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরূল ইমাম বলেন, সরকার দুই বছরে ৪৬টি কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে। ভালো উদ্যোগ। আশা করি আগের ১০৫টি কূপ খনন প্রকল্পের মতো হারিয়ে না যায়। বঙ্গোপসাগরে আমাদের সীমানার ওপারে মিয়ানমার অনেক গ্যাস উত্তোলন করছে। অথচ আমরা গত ১০ বছরে কিছুই করতে পারিনি। এখন সাগরে বিডিং রাউন্ডে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে, স্থলভাগেও কাজ শুরু হয়েছে। তবে এটা খুব বেশি বিলম্বিত হয়েছে। এটা ১০ বছর আগে করা গেলে আজকের এই সংকটের সৃষ্টি হতো না। জ্বালানি প্রাকৃতিক সম্পদ, আর যেহেতু সংবিধান অনুযায়ী প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক জনগণ এমন মন্তব্য করে অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, সংবিধান বলেছে তিন ধরনের মালিকানা অনুমোদনযোগ্য। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান হতে হবে দেশীয় উদ্যোগ, বিদেশি থাকতে পারে সম্পূরক হিসেবে। সমুদ্রে খনিজ সম্পদ আহরণে জাতীয় স্বার্থকে অক্ষুণœ রেখে চুক্তি হতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে প্রতি বছর বিদ্যুতের ব্যবহার ৭ শতাংশ হারে বেড়েছে, আর উৎপাদন বেড়েছে ১২ শতাংশ হারে। এতে করে অনেক বিদ্যুৎ অব্যবহƒত থেকে যাচ্ছে। যার ফলে বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। সরকার সম্প্রতি বিইআরসির ক্ষমতা খর্ব করেছে। বিইআরসি যখন দাম নির্ধারণ করে সেখানে কিছুটা হলেও স্বচ্ছতা থাকে, জবাবদিহি থাকে।
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া মন্তব্য করেন, সরকার বঙ্গবন্ধুর নীতিকথার কথা বলেন, কিন্তু কাজ করছেন তার নীতির বাইরে। কাফকোকে দেশীয় দামে গ্যাস দিতে হতো। আর তার কাছ থেকে সার কিনতে হতো সিঙ্গাপুরের দরে। সরকার বঙ্গবন্ধুর নীতি কথার কথা বলে, কিন্তু কাজ করছে; তার নীতির বাইরে। কারণ তারা রাতারাতি ধনী হতে চাচ্ছে। আমরা লুটপাটকে আর বেশি প্রসারিত করেছি। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ক্যাবের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অভিযোগ অনুসন্ধান এবং গবেষণা কমিশনের সদস্য অধ্যাপক সুশান্ত কুমার দাস, ক্যাবের সদস্য স্থপতি ইকবাল হাবিব, ক্যাবের আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান, সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদের সহসাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, সংসদ সদস্য শামিম হায়দার পাটোয়ারী প্রমুখ।