ইসমাইল আলী: বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দর ঊর্ধ্বমুখী। এতে প্রতিদিন প্রায় ১১০ কোটি টাকা লোকসান গুনছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তাই এ খাতে ভর্তুকি কমাতে জ্বালানি সাশ্রয়ের পথে হাঁটতে চায় সরকার। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর চিন্তাভাবনাও চলছে। আর বিদ্যুৎ খাতের চিত্র আরও নাজুক। গত জানুয়ারি পর্যন্ত ১৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়া বন্ধ রাখা হয়েছে।
এদিকে ভতুকি বন্ধ থাকায় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল পরিশোধ বন্ধ করে দিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। ঘাটতির সাময়িক সমাধানে জুন মাসের গ্রাহকের কাছ থেকে আদায়যোগ্য বিল বিদ্যুৎ সঞ্চালন কোম্পানিগুলোকে অগ্রিম জমা দিতে বলেছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে নগদ তহবিল সংকট চরম আকার ধারণ করেছে।
সংকট মোকাবিলায় রাত ৮টায় দোকানপাট বন্ধের মাধ্যমে মূলত সন্ধ্যায় পিক ডিমান্ড কমিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন ও খরচ কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে বিদ্যুৎ খাতে আর ভর্তুকি না দিলে দ্রুত বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। অন্যথায় খরচ কমাতে দিতে হবে লোডশেডিং।
তথ্যমতে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এক মাসের ব্যবধানে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি গড়ে প্রায় ১৬ ডলার বেড়েছে। এ অবস্থায় দেশের বাজারে ডিজেল ও অকটেন বিক্রিতে বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে বিপিসিকে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিন প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রিতে ৫৭ টাকা এবং অকটেনে ৩৭ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। ফলে দাম বৃদ্ধি না করে কোনো উপায় দেখছে না সংস্থাটি।
বিপিসি বলছে, অপরিশোধিত তেলের দাম ৮০ ডলারের মধ্যে থাকলে লোকসান হয় না। বর্তমানে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল দাম ১২০ ডলারের ওপরে। তবে ডিজেলে প্রায় পুরোটাই আনা হয় পরিশোধিত তেল হিসেবে যার দাম আরও বেশি। গত ১৬ জুন ব্যারেলপ্রতি ডিজেলের দাম ছিল ১৭৪ ডলার। এতে প্রতিদিন যে পরিমাণ লোকসান হচ্ছে তাতে আগামী অর্থবছরের তেল কেনার টাকার সংকট দেখা দেবে।
সংস্থাটি জানায়, বর্তমানে দেশের জ্বালানি তেলের চাহিদা ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের কিছুটা কম তথা ১৫ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত তেল দেশে এনে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন করে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি, যেমন পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল, কেরোসিনসহ বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করা হয়। বাকি চাহিদা পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে মেটানো হয়।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে লিটারপ্রতি ডিজেলের দাম অনেক কম। দেশে বর্তমানে ডিজেলের লিটারপ্রতি দাম ৮০ টাকা। অথচ ভারতে এখন তা ১১০ টাকা, পাকিস্তানে ৯৪ টাকা, নেপালে ১১৩ টাকা ও শ্রীলঙ্কায় ১০১ টাকা। তবে সবচেয়ে বেশি দাম ডিজেলের এখন হংকংয়ে। দেশটিতে ২০৫ দশমিক ৫২ টাকায় ডিজেল বিক্রি হচ্ছে।
এ অবস্থায় জ্বালানি সাশ্রয়ে গত ১৬ জুন সারাদেশে প্রতিদিন রাত ৮টার পর দোকানপাট, শপিংমল, মার্কেট ও বিপণিবিতান বন্ধ রাখতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। জননিরাপত্তা বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, শিল্প মন্ত্রণালয়, কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সমস্ত বিভাগীয় কমিশনার, সমস্ত রেঞ্জের মতো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবগণকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয়। পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক, সব জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬’-এর ১১৪ ধারা অনুযায়ী কঠোরভাবে আদেশ কার্যকর করার জন্য বলা হয়েছে।
এদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হবে। সেটা কবে নাগাদ হতে পারেÑসাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখনও দেশের বাজারে যে তেল মজুত আছে সেটা তুলনামূলক কিছুটা কম দামে কেনা। ফলে সামনের মাসের (জুলাই) যে কোনো সময় দাম সমন্বয় করা হবে। তবে সে ক্ষেত্রে মানুষের ওপর থেকে কী করে তেলের মূল্য বৃদ্ধির চাপ কমিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে কাজ করছে মন্ত্রণালয়।
তিনি বলেন, অতীতে দেখা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে যেখানে কিলোমিটারে ৩০ পয়সা গণপরিবহনে ভাড়া বাড়ানোর কথা, সেখানে দুই থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়ে নিয়েছেন মালিকরা। ফলে মানুষের কষ্টও বেড়েছে। তাই এবার দাম বাড়ানোর আগে সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। বিশেষ করে কার্গো মালিক, লঞ্চ মালিক, বাস মালিক ও বিআরটিএ’র সঙ্গে বৈঠক করা হবে।
অপরদিকে জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বমুখী দাম ও গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুতে বড় অঙ্কের লোকসান গুনছে পিডিবি। চলতি অর্থবছর ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সংস্থাটির লোকসান দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৮১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। তবে বছরশেষে তা ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এজন্য গত জানুয়ারিতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে পিডিবি। গত মাসে তার ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
চলতি মাসে এর ওপর পোস্ট হেয়ারিং অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে পিডিবি জানায়, চলতি অর্থবছর পিডিবিকে সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ভর্তুকি দেয়া হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেয়া বন্ধ রেখেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি।
পোস্ট হেয়ারিংয়ে পিডিবি আরও জানায়, বর্তমানে বিদ্যুৎ সরবরাহে যা খরচ হয় তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ঘাটতি থাকে। তবে জানুয়ারিতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের সময় অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলার হিসাব করা হয়েছিল। মে মাসের শেষে তা ১১০ ডলারে পৌঁছেছে। বেসরকারি কোম্পানিগুলোর ফার্নেস অয়েল আমদানিতে প্রতি লিটারে খরচ পড়ছে প্রায় ১০০ টাকা। আর পিডিবিকে কিনতে হচ্ছে ৭৪ টাকায়। তাই ভর্তুকি না দিলে অথবা দ্রুত বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে ঘাটতি মেটাতে লোডশেডিং দিতে হবে। আর দৈনিক এ লোডশেডিংয়ে পরিমাণ সাত থেকে সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াটও হতে পারে।
এদিকে ঘাটতির সাময়িক মোকাবিলায় গ্রাহকের কাছ আদায়যোগ্য জুনের বিদ্যুৎ বিল কোম্পানিগুলোর কাছে অগ্রিম চেয়েছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়, যদিও এ নিয়ে বিব্রত কোম্পানিগুলো। এ প্রসঙ্গে ঢাকায় বিদ্যুৎ সঞ্চালনের দায়িত্বে থাকা এক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘জুনে আমাদের ডিএসএল (ঋণের কিস্তি) পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া জুনের কালেকশন থেকে ঈদুল আজহার বোনাসও পরিশোধ করতে হবে। এ সময় অগ্রিম বিল জমা দেয়া খুবই কঠিন। তবু চেষ্টা করা হচ্ছে।’