বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত কি শ্বেত হস্তিতে পরিণত হচ্ছে?

নিজস্ব প্রতিবেদক: বর্তমানে সারাদেশেই লোডশেডিং চলছে। এ লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে তা এ সংকট নিরসনে যথেষ্ট নয়। আবার বর্তমানে যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা তার চেয়ে অনেক বেশি। তা সত্ত্বেও নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এত বাড়তি সক্ষমতা দিয়ে কী লাভ হবে? একই সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে যতটা জোর দেয়া হয়েছে, বিতরণ ও সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণে ততটা জোর দেয়া হয়নি। আর বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এ ভর্তুকির বেশিরভাগ অর্থ চলে যাচ্ছে বেসরকারি কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে। অন্যদিকে জ্বালানি খাতে তেমন নজর দেয়া হয়নি। জ্বালানি খাত সিংহভাগ আমদানিনির্ভর, যা দেশের রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত শ্বেতহস্তিতে পরিণত হচ্ছে কি না তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক সংলাপে এমন বক্তব্য দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। রাজধানীর লেকশোর হোটেলে গতকাল ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা: ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে প্রস্তাবিত পদক্ষেপসমূহ’ শীর্ষক এ সংলাপের আয়োজন করা হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

সভায় জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) এখন আর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) যাওয়া লাগছে না। আইন পরিবর্তন করে বিপিসিকে ব্যবসায়ী বানানো হয়েছে। তারা এখন নিজেই ফার্নেস অয়েল, জেট ফুয়েলের দাম নির্ধারণ করে। অর্থাৎ, ব্যবসায়ী নিজেই তার পণ্যের দাম নির্ধারণ করে। এত বড় অবিচার ভূ-ভারতে কোথাও আছে কিনা জানা নেই। আইন পরিবর্তন করে গণশুনানি তুলে দেয়া হলো। যাতে আমরা বলতে না পারি কত হাজার কোটি টাকা কোথায় চুরি হয়েছে। কোথায় লুটপাট হয়েছে, কীভাবে হয়েছে তা জানতে যেন না পারি সে কারণে।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০২২ সালে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় দেখা গেল জ্বালানি উন্নয়ন তহবিলের ৬৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়নি। ৩৫ শতাংশ জ্বালানি কোথায় কীভাবে ব্যয় করা হয়েছে সেটা কেউ বলতে পারছে না। আমরা জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলে টাকা দিয়ে যাচ্ছি। এগুলো না দিলে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম কমত। আমাদের টাকার ওপর সুদ নেয়া হচ্ছে। এভাবে আমরা ঠকছি।’

সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বুয়েটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, বর্তমানে সমস্যা বিরাজ করছে জ্বালানি খাতে। অথচ বাজেটে বরাদ্দ বাড়ছে বিদ্যুৎ খাতে। গত বছর সংকটে পড়ে গ্যাস অনুসন্ধান বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। এখন বিশ্ববাজারে কয়লা,

 এলএনজি ও জ্বালানি তেলের দাম কম। তাই সরকার আবার আমদানির দিকেই ঝুঁকছে। জ্বালানির নিশ্চয়তা না নিয়ে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে। এগুলো তো যেকোনো আইনে অবৈধ হওয়ার কথা।

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দ্রুত বিদ্যুৎ দিতে পারায় শিল্পায়ন বেড়েছে। এখন ব্যবসায়ীদের কাছে পরিস্থিতি অন্ধকার, বিদ্যুৎ নেই। জ্বালানি আমদানিনির্ভর হয়ে গেছে। জ্বালানির প্রাপ্যতা মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। ডলারের সংকটে ঠিকমতো ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। নগদ টাকা দিয়ে ব্যবসায়ীরাও ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে একদিকে যেমন উৎপাদন কমতে থাকবে অন্যদিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও হবে না।

মূল প্রবন্ধে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমানে সারাদেশে তীব্র লোডশেডিং চলছে। আর এ লোডশেডিংয়ের মাত্রা শহরের তুলনায় পল্লী অঞ্চলে আরও বেশি। কিন্তু খুব শিগগিরই এ লোডশেডিং কমে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ লোডশেডিং হ্রাস করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়।

বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের যে চাহিদা রয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নতুন নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনুমোদন দেয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের মতো। আর এখন উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ২৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এরপরও নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এত বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে আমরা কী করব, যদি এগুলো ব্যবহার করা না যায়? তিনি বলেন, ‘বেসরকারি খাতে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোতি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সেগুলোর পূর্ণ সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে না। ফলে কেন্দ্র বসে থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে। এতে করে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে।’

মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা থাকবে প্রায় ৪৬ শতাংশ। আর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সরকার আগামী অর্থবছরের জন্য যে বরাদ্দ নির্ধারণ করেছে তার ৯৩ শতাংশই যাবে বিদ্যুতে। মাত্র ৭ শতাংশ যাবে জ্বালানি ও খণিজসম্পদ খাতে। আর বিদ্যুতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগই চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। সঞ্চালন ও বিতরণ কার্যক্রমে কম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ফলে অনেক কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও সঞ্চালন লাইন না থাকায় সেখান থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে আনা সম্ভব হয় না। এ জন্য সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের ওপর জোর দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়।

মূল প্রবন্ধে আরও জানানো হয়, বিদ্যুৎখ াতে প্রাথমিক জ্বালানির চাহিদা মেটাতে ফার্নেস তেল ও অন্যান্য জ্বালানি আমদানির জন্য বছরে ১৭ থেকে ১৮টি ঋণপত্র (এলসি) খোলার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে ৪ থেকে ৫টির বেশি এলসি খোলা সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকারের ভুল নীতি দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়। জানানো হয়, যে দেশের অভ্যন্তরে জ্বালানি অনুসন্ধানে গুরুত্ব না দিয়ে সরকার পুরোপুরি আমদানিনির্ভর একটি ব্যবস্থা চালু করেছে। এর ফলে বর্তমানে সংকট দেখা দিয়েছে। গত ১০ বছরে যদি প্রতি বছর অন্তত ২০-২৫টি কূপ খনন করা হতো, তাহলে সেখান থেকে প্রতি বছর অন্তত চার থেকে পাঁচটি কূপ থেকে গ্যাস পাওয়া যেত, যা দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চাহিদা মেটানো সম্ভব হতো। কিন্তু সরকার সেটি না করে পুরোপুরি আমদানির ওপর নির্ভর করেছে। এই ভুল নীতির খেসারত দিতে হচ্ছে এখন।

গোলাম মোয়াজ্জেম উল্লেখ করেন, দেশে বিদ্যুৎ খাতে মোট যে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়, তার ৩৪ শতাংশই আসে ভর্তুকির মাধ্যমে, এ ভর্তুকি এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। আর এ ভর্তুকির অর্থের বড় অংশই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘সরকারের অর্থের সংকট রয়েছে। যে কারণে এক অর্থবছরের ক্যাপাসিটি চার্জ পরের অর্থবছর পরিশোধ করা হচ্ছে।’ উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২০২১-২২ অর্থবছরের ১৭ হাজার কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে। আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ক্যাপাসিটি চার্জবাবদ বকেয়া জমে গেছে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা, যা আগামী অর্থবছরে পরিশোধ করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করতে হবে, তার জন্য বছরে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ ব্যয় করতে হবে। এ ব্যয় ২০৩০ সাল নাগাদ ২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে। কাজেই এই বিপুল পরিমাণ ডলারের জোগান নিশ্চিত করা দুরূহ ব্যাপার। সে জন্য বর্তমানে সরকার যে কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে, তা থেকে দ্রুত সরে আসতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতের জন্য যে সমন্বিত মহাপরিকল্পনা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার আমূল সংস্কার করার প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি। এ সংস্কারের মাধ্যমে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতি জোর দে]য়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। এক্ষেত্রে ২০৪১ সাল নাগাদ মোট চূড়ান্ত জ্বালানির ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য খাত থেকে আহরণে প্রধানমন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নে নীতি সংস্কারের প্রস্তাব দেয়া হয়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০