বিদ্যুৎ সংকটে ধুঁকছে উত্তরাঞ্চল

প্রতিনিধি, রাজশাহী: উত্তরাঞ্চলে চলমান বিদ্যুৎ সংকট জনজীবনে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপদাহের মধ্যে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে সাধারণ মানুষ অসহ্য দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে। বিদ্যুতের এ ঘাটতির ফলে ঘর থেকে বাজার, অফিস থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবকিছুতে কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে, গ্রামাঞ্চলের মানুষ এবং বৃদ্ধ ও শিশুদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, সবখানে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে, যা পুরো অঞ্চলের অর্থনীতিকেও সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষ করে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে বিদ্যুতের লোডশেডিং বর্তমানে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এ দুই বিভাগের ১৬টি জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে নর্দান ইলেকট্রিসিটি পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো)। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুতের সরবরাহ চাহিদা অনুযায়ী পাওয়া যাচ্ছে না। তাই গ্রাহকদের প্রয়োজন মেটাতে প্রতিষ্ঠানটি হিমশিম খাচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের শিল্প-কারখানাগুলোর উৎপাদন কার্যক্রমও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

রাজশাহীতে বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি: রাজশাহী নগরের বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্যুতের এমন লোডশেডিং গত কয়েক দিনের চিত্র। ভ্যাপসা গরমের মধ্যে এমন লোডশেডিংয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। রাজশাহীর কয়েকটি উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। তাদের লোডশেডিং নেসকোর চেয়ে বেশি। এতে সেচ সংকটে পড়েছে গ্রামের কৃষক। নেসকোর রাজশাহী জোনের প্রধান প্রকৌশলী জাকির হোসেন জানান, রাজশাহী বিভাগের ৮টি জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ১ হাজার ২৭৭ মেগাওয়াট হলেও তারা জাতীয় গ্রিড থেকে মাত্র ১ হাজার ১৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। ফলে ঘাটতি মেটাতে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১১০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

তিনি জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হওয়ার কারণেই এ সংকট তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি আরেকটি পাওয়ার স্টেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তবে কবে এ সমস্যার সমাধান হবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়।পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির রাজশাহী জেলার জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক রমেন্দ্র চন্দ্র রায় বলেন, আমরা জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ নিই না। আমাদের বিদ্যুৎ আসে রাজশাহীর কাটাখালী উপকেন্দ্র থেকে। সেখান থেকেও আমরা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পিক আওয়ারে বড় জোর ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। বাকি সময়ও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। দিনে তাদের বিদ্যুতের চাহিদা থাকে ৪৫ থেকে ৫০ মেগাওয়াট। আর রাতে পিক আওয়ারে চাহিদা থাকে ৬০ থেকে ৭০ মেগাওয়াট।
রংপুরে বিদ্যুৎ সংকটের তীব্রতা: রংপুরের জেলাগুলোয় প্রতি তিন ঘণ্টা পর এক থেকে দেড় ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে। জেলার কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। তাদের অবস্থা আরও খারাপ। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পিক আওয়ারে চাহিদার ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎও মিলছে না বলে সমিতি জানিয়েছে।

নেসকোর রংপুর জোনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম জানান, রংপুরের ৮টি জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ১,০৫০ থেকে ১,১০০ মেগাওয়াট হলেও তারা জাতীয় গ্রিড থেকে মাত্র ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। ফলে নিয়মিত লোডশেডিংয়ের বিকল্প নেই। প্রতিদিন তিন ঘণ্টা পরপর এক থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে লোডশেডিংয়ের ভয়াবহতা: চাঁপাইনবাবগঞ্জেও লোডশেডিংয়ের মাত্রা ৪৫ শতাংশে পৌঁছেছে। আবাসিক ও ব্যবসায়িক উভয় ক্ষেত্রেই বিদ্যুৎ সংকট চরমে উঠেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার বিদ্যুতের চাহিদা ৩৩ মেগাওয়াট হলেও সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ২০ থেকে ২২ মেগাওয়াট। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশাল প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎনির্ভর ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলোয় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

নেসকো চাঁপাইনবাবগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী আলিউল আজিম বলেন, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ অর্ধেক। ফলে লোডশেডিং চলছে। সহসাই পরিস্থিতির উন্নতি হবে কি না, তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির গ্রাহকরাও পরিস্থিতির শিকার। তাদের বিদ্যুতের চাহিদার ৪০ শতাংশ মেটানো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। ফলে গ্রামের কৃষকরা সেচের কাজে বিদ্যুৎ সংকটে পড়েছেন, যা কৃষি উৎপাদনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী মো. ছানোয়ার হোসেন বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমাদের প্রায় ৩ লাখ ৪৬ হাজার গ্রাহক। আমরাও চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম পাচ্ছি। ফলে আমাদের আওতাধীন সঞ্চালন লাইনে ৪০ শতাংশ লোডশেডিং চলছে। পরিস্থিতি উন্নতির বিষয়ে উৎপাদন-সংশ্লিষ্টরা বলতে পারবেন বলে জানান তিনি।
ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ: ব্যবসায়ীরা জানান, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে তাদের কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অনেক কারখানায় দিনে অর্ধেক সময় বিদ্যুৎ না থাকায় উৎপাদন কমে যাচ্ছে, যা ব্যবসায়িক খরচও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎনির্ভর ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলোয় এর প্রভাব আরও বেশি। অনেক ব্যবসায়ী আশঙ্কা করছেন, যদি বিদ্যুৎ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হয়, তবে তাদের আরও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।

রাজশাহীর সাহেববাজারের মুদি দোকানের মালিক মাহবুবুল আলম বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যবসা পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দিনের অর্ধেক সময় বিদ্যুৎ না থাকায় ক্রেতারা দোকানে আসতে চায় না। দোকানে এসেও গরমের কারণে বেশি সময় থাকেন না। ব্যবসায়িক কার্যক্রম পুরোপুরি ব্যাহত হচ্ছে। এদিকে, ফ্রিজে রাখা জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে যেসব পণ্য বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল, সেগুলোয় বেশি ক্ষতি হচ্ছে। ব্যবসার খরচ বেড়ে গেছে, অথচ বিক্রি কমে গেছে।
তিনি আরও বলেন, যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান না হলে অনেক ব্যবসায়ী চরম ক্ষতির মুখে পড়বে। এমন চলতে থাকলে দোকান চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০