বিদ্যুৎ সংকট রোধে নাগরিকদের করণীয়

রেহেনুমা সেহেলী কবির: তেল, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে উৎপাদিত বিদ্যুৎ একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক উল্লেখযোগ্য মাপকাঠি। আর উৎপাদিত এই বিদ্যুতে যথাযথ সরবরাহ নিশ্চিতকল্পে  ‘লোডশেডিং’ শব্দটি আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বছর কয়েক আগেও নতুন ছিল না। কিন্তু বর্তমান সরকারের সাফল্য স্বরূপ বিদ্যুতের সহজলভ্যতায় শব্দটি প্রায় সেকেলে রূপ নিচ্ছিল এদেশে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ; জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজারে যে অস্থিরতা তৈরি করেছে তার প্রভাব পড়ছে আমাদের দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানির প্রাপ্যতা কমে যাওয়ায় এবং বিশ্ববাজারে অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির ফলে ইতোমধ্যেই প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন। ফলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহে সাম্যাবস্থা রক্ষার্থে লোডশেডিং সমস্যা আবারও একটি নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। যার ফলে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ আর ভ্যাপসা গরম আরও বেশি অসহনীয় হয়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে সরকারি বেশ কিছু উদ্যোগ গৃহীত হলেও এই সংকটের সময়সীমা কারোরই অনুমেয় নয়। তাই বিদ্যুৎ ব্যবহারে ব্যক্তিগতভাবে আগাম সচেতনতা অবলম্বন করার কোনো বিকল্প নেই।

বিদ্যুৎ কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নয় বরং এটি জাতীয় ও বৈশ্বিক সম্পদ। তাই এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে সংকট উত্তরণে সহায়তা করাও রাষ্ট্রে বসবাসকারী সকল নাগরিকের কর্তব্য। সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ব্যতীত এই সামষ্টিক সম্পদের যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিতকরণ সম্ভব নয়।

তাই এই সংকটাপন্ন অবস্থায় বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি  আমাদের সবার উচিত যে যার অবস্থান থেকে সচেতন হওয়া। এক্ষেত্রে বিদ্যুতের অপচয় রোধের কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী মনোভাব সৃষ্টি করা গেলে বিদ্যুতের মোট চাহিদা তুলনামূলক কমিয়ে আনা যাবে। আর এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম করণীয় হচ্ছে বিদ্যুতের অযাচিত ব্যবহারের ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করে সীমিত ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং বিদ্যুৎ শক্তির বিকল্প উৎস অনুসন্ধান করা। যেহেতু নিত্যনতুন প্রযুক্তি নির্ভরতা বিদ্যুতের চাহিদাকে ক্রমেই বৃদ্ধি করছে, সেহেতু প্রযুক্তির ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতা কাটানোর জন্য নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।

তাছাড়া নি¤েœাক্ত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণের মাধ্যমে বিদ্যুতের অপচয় অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। যেমনÑ১. প্রয়োজন ব্যতীত ফ্যান, লাইট, পি, সি, ওভেন ইত্যাদি বন্ধ রাখা এবং মাইক্রোওয়েভ, রাইস কুকার, কারি কুকারের ব্যবহার যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করা। ২. অপ্রয়োজনে দেয়ালের বিভিন্ন পয়েন্টে চার্জার লাগিয়ে না রাখা। এতে করেও কিছু পরিমাণ বিদ্যুৎ অপচয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে। ৩. ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎ সংযোগ সারিয়ে তোলা। ৪. বৈদ্যুতিক বাতি ও ফ্যানে ইলেকট্রনিক্স রেগুলেটর ব্যবহার করা। ৫. সাধারণ বাল্বের তুলনায় এনার্জি সেভিং বাল্ব আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহƒত বিদ্যুতের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে বিধায় এনার্জি সেভিং বাল্ব ব্যবহারকে উৎসাহিত করা উচিত। ৬. যেহেতু ফ্যানের চেয়েও এসিতে বিদ্যুৎ অপচয় বেশি হয়, সেহেতু এসির বদলে ফ্যান ব্যবহার করা আপৎকালীন সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত হতে পারে। ৭. দিনের বেলা লাইট না জ্বালিয়ে ঘরের দরজা-জানালা খুলে রেখে দিনের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এছাড়া ওয়াশিং মেশিনে কাপড় ধোয়া, হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকানো কিংবা ফ্যান ছেড়ে কাপড় শুকানোর মতো বিলাসিতা এই মুহূর্তে পরিহার করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে সৌরশক্তি ও সূর্যালোক সর্বোত্তম বিকল্প। পানি গরম করতে হিটার বা গিজারের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা, দিনের আলোয় অভ্যস্ত হওয়া, উৎসব অনুষ্ঠানে আলোকসজ্জার ব্যবহার হ্রাসকরণ, শপিং কমপ্লেক্স, মার্কেট, রেস্টুরেন্টে অযথা বিদ্যুৎ ব্যবহার রোধ করা ইত্যাদি।

“যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি, আশু গৃহে সে দেখিবে না আর নিশীতে প্রদীপ বাতিÑশৈশবে পঠিত এই পঙ্ক্তিমালার যথার্থ বাস্তবায়নের এখনই সময়। অন্যথায় বিদ্যুৎ সংকটের চলমান পরিস্থিতি আমাদের সহনশীলতার মাত্রাকে ছাড়িয়ে যাবে অনেক দূর। এছাড়া অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে মুখ থুবড়ে পড়বে দেশের অর্থনীতি কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সরকারি বিভিন্ন নির্দেশনা এলেও ব্যক্তিগতভাবে আমরা এখনও নিষ্ক্রিয়। বিদ্যুতের সহজলভ্যতা এবং আমাদের আরামপ্রিয় মানসিকতাই এই উদাসীনতার মূল কারণ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সামান্য সাবধানতাই পারে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবিলা  করতে। এ অবস্থায় আমার একার সাবধানতায় কী ফল হবে! এরূপ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বরং সম্ভব হলে বিদ্যুৎ অপচয়ের কুফল ও দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব সম্পর্কে আশপাশের বন্ধু, পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনকে বোঝাতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপন, লিফলেট বিতরণ কিংবা সামাজিক প্রচারণা চালিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যেহেতু ব্যক্তির সমষ্টিই জাতি। সেহেতু আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত উদ্যোগই পারে জাতীয় সংকট নিরসনে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে। এরই লক্ষ্যে আমাদের প্রতিদিনের গৃহস্থালি কাজ থেকে শুরু করে যাবতীয় সকল কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সচেতনতা এখন সময়ের দাবি। এছাড়া বিদ্যুৎ সংকটের স্থায়ী সমাধানকল্পে বিকল্প শক্তির উৎস অন্বেষণের কোনো বিকল্প নেই। এমন কয়েকটি উৎস হতে পারে সৌরশক্তি, স্রোত ও পানিপ্রবাহের শক্তি, সৌর খামার, ঘরোয়া বায়ুশক্তি, বায়ু খামার, ভূ-উত্তাপ শক্তি, সমুদ্র তাপীয় শক্তি। বিদ্যুতের অপচয় রোধ করার পাশাপাশি এসব বিকল্প উৎসের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিদ্যুৎ সংকট নিরসন করা সম্ভব।

শিক্ষার্থী

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০