বিদ্রোহী কবির প্রেমকানন

দ্রোহ ও প্রেমের অপার মিশেলে বিধাতা সাজিয়েছেন কবি নজরুল ইসলামের চিন্তা ও অনুভূতির জগতকে। তিনি নিজেকে তুলনা করেছেন পরশুরামের কঠোর কুঠারের সঙ্গে। কখনও বা কুমারীর প্রেমে মজেছেন। সেই প্রিয়জনের দেখা পেতে পাড়ি দিয়েছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। কুমিল্লাও কবির পদচারণায় মুখর হয়েছে।
কুমিল্লা শহর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মুরাদনগরের দৌলতপুর গ্রাম। প্রশস্ত সড়কের হাতের বাম পাশে ঘুরলেই চোখে পড়বে বীণা-সদৃশ দুটো উঁচু ভাস্কর্যের ফটক। রাস্তার দু’পাশে গানের কলির কয়েকটি ছোটো নামফলক। ভেতরে প্রবেশের পর মনে হবে যেন কোনো শিল্পীর গানের স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন! মূল ফটকের রাস্তা ধরে প্রায় ১০ মিনিটের সময় লাগে এখানে আসতে।
অতঃপর চোখে পড়বে খানবাড়ির ঐতিহাসিক পুকুর। পুকুরপাড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মিলবে একটি বয়োবৃদ্ধ সুবিশাল আমগাছ। কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে গাছটি। এ গাছের নিচে বসে যৌবনের অনেক সময় কাটিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
স্থানীয়দের কাছে তিনি ‘বর্ধমাইন্না পুরুষ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জানা যায়, কঁচিকাঁচাদের নিয়ে গানের আসরও জমাতেন এই আমগাছের নিচে। পুকুরে স্নান করতেন মনের সুখে। প্রিয়তমার প্রতি ভালোবাসার টানে খানবাড়ির সবকিছুু কবির কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে।
মুন্সি আবদুল খালেক ও আসমাতুন্নেসার কন্যা নার্গিস আসার খানম। আসল নাম সৈয়দা খানম। খানবাড়ি থেকে পাঁচ-ছয়টি বাড়ির উত্তরে তার নিজ বাড়ি। ছোটবেলায় মামা আকবর আলী খানের বাড়িতে বেড়ে ওঠেন নার্গিস। সৌন্দর্যের পরশ ছড়িয়ে উজ্জ্বল করেন মামাবাড়ির প্রতিটি অঙ্গন। এখানেই যৌবনে পদার্পণ করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, আকবর আলী খান ঢাকার প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরির তত্ত্বাবধানে থাকাকালে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এছাড়া আকবর আলী খান তৎকালীন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেনাবাহিনীর অফিসার থাকাকালীন সৈনিক নজরুলের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে।
১৯২১ সালে কবি দৌলতপুরে আসেন। নার্গিসকে প্রথম দেখায় মুগ্ধ হন তিনি, ভালোবেসে ফেলেন। খানবাড়ির পুকুরপাড়ে বসে প্রিয়তমার জন্য প্রহর গুনতেন আর হƒদয়ের আবেগগুলো প্রকাশ করতেন কবিতার চরণে। ছায়ানট, পুবের হাওয়া, চক্রবাক কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা প্রিয়তমা নার্গিসকে উপলক্ষ করে লেখা। ছায়ানটের অবেলায়, হারামণি, পাপড়ি খেলাসহ ৯টি কবিতা নার্গিসকে নিয়ে লিখেছেন। পাপড়ি খেলা কবিতাটি যেন নার্গিসের প্রতি কবির ভালোবাসার অমর নিদর্শন:
‘রেশমি চুড়ির শিঞ্জিনিতে রিমঝিমিয়ে মরম কথা,
পথের মাঝে থমকে কে গো, থমকে যায় ঐ শরম লতা।
কাখচুমা তার কলসি ঠোঁটে, উল্লাসে জল উলসি উঠে,
অঙ্গে নিলাজ পোলক ছোটে বায় যেন হায় নরম লতা’
জানা যায়, ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ৩ আষাঢ়, শুক্রবার কবির সঙ্গে বিয়ে হলেও কাবিননামায় ঘরজামাই থাকার শর্তকে কবি মেনে নিতে পারেননি। এ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলে নজরুল বাসর সম্পন্ন না করে নার্গিসকে ছেড়ে দৌলতপুর ত্যাগ করেন। ১৫ বছর পর নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের দেখা হয়। তখন তাদের আনুষ্ঠানিক বিয়েবিচ্ছেদ ঘটে। পরবর্তী সময়ে কবি আজিজুল হাকিমের সঙ্গে নার্গিসের দ্বিতীয় বিয়ে সম্পন্ন হয় এবং স্বামীর সঙ্গে বিদেশে পাড়ি জমান তিনি।
বিয়েবিচ্ছেদ হলেও কবির ভালোবাসা ছিল নিত্য ও অক্ষয়। কবির জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন নার্গিস। দৌলতপুরের সেই নিদর্শনগুলো ভালোবাসার অমর সাক্ষী হয়ে আছে আজও। কবির আটচালা টিনের ঘর, বাসরঘর, অন্যান্য কক্ষ, ব্যবহৃত খাট ও জিনিসপত্র দেখা যাবে দৌলতপুরের এই খানবাড়িতে। এর দক্ষিণে নির্মাণ করা হয়েছে নজরুলমঞ্চ। যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে বিশেষ দিনে স্মরণ করা হয়। ১১ জ্যৈষ্ঠ নজরুলমেলাও হয় এখানে।
কুমিল্লায় নজরুলকে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য যিনি সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছেন, তিনি হলেন নজরুল গবেষক বুলবুল ইসলাম। কবি নজরুলের স্মৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব নেন তিনি। তবে নার্গিসের পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, সরকারের ওপরমহলের যথাযথ আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। তবুও কবিপ্রেমী ও ভক্তদের কাছে দৌলতপুরের এই স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো অনায়াসেই মনের মধ্যে দাগ কাটে। যুগ যুগ ধরে টিকে রইবে তাদের এই প্রেমের নিদর্শনগুলো, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে জীবন্ত হয়ে থাকবে।

হোসাইন কামাল

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০