ধরুন অফিস থেকে বাসায় ফিরেছেন। দরজা খুলতে পারছেন না। চাবি কাজ করছে না। আবার ধরুন সারা দিন ব্যস্তময় জীবনযাপন করে বাসায় ফিরে দেখেন, এসি বা ফ্যান চলছে না। কী করবেন তখন? হয়তোবা ছোটাছুটি করবেন। আর মেকানিক না পেলে মেজাজ বিগড়ে যাবে নিশ্চয়। কেমন হয় এসব সমস্যার সমাধান একসঙ্গে হলে? আসলেই নগরজীবনের নানা সমস্যার সমাধান নিয়ে এসেছে ‘ডিজিটাল মানুষ’ নামের একটি অ্যাপ। ডিজিটাল মানুষের স্লোগান ‘অন প্ল্যাটফরম’, ‘অল সার্ভিস’।
বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাসের সমস্যা সমাধানের উপায় বাতলে দেওয়ার পাশাপাশি স্যানিটারি, বাসার রঙ, তালা, গাড়ির মিস্ত্রি থেকে হকার, লন্ড্রি, ইন্টারনেট, গৃহশিক্ষক, তাঁতি, বাসা বদলের জন্য শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গেও সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবেন ডিজিটাল মানুষের মাধ্যমে। অ্যাপটির উদ্যোক্তা
মো. খন্দকার আলিফ। ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছেন।
ডিজিটাল মানুষ অ্যাপটি তৈরির পেছনে লুকিয়ে আছে আলিফের ব্যক্তিগত কিছু ঘটনা। একদিন বাসায় আছেন তিনি। সারা দিন কাজ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সেদিন। তার ছোট ভাই খন্দকার কাফি আনান স্কুল শেষে বাড়িতে আসে। দরজায় বেল দিতে থাকে। ঘুমিয়ে পড়ার কারণে কলিংবেলের শব্দ শুনতে পাননি আলিফ। এদিকে সারা দিন ক্লাস করে আনান ক্লান্ত ছিল। বেচারার অপেক্ষা যেন ফুরোয় না। অনেকক্ষণ পর সে তালার মিস্ত্রি খুঁজতে বের হয়। কিন্তু তার জানা নেই, কোথায় তালার মিস্ত্রি পাওয়া যায়? খুঁজে খুঁজে আরও ক্লান্ত হয়ে গেল। হতোদ্যম হয়ে বাসায় ফিরে দেখে, আলিফ ভাইয়া ঘুম থেকে উঠে হাই তুলছেন। এ ধরনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটে আমাদের পরিবারের সঙ্গেও। এ থেকেই মাথাই আসে অ্যাপ বানানোর চিন্তা।
একদিন খন্দকার অলি উল আজম, আলিফ, আনানÑ তিন ভাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, এ
সমস্যার সমাধান করতে হবে। আলিফ চিন্তা করলেন, একটা অ্যাপ বানালে কেমন হয়? অ্যাপটি দিয়ে তালার মিস্ত্রি খুঁজে পাওয়া যাবে। এই শুরু ডিজিটাল মানুষের পথচলা। অ্যাপটি তৈরিতে আলিফকে সহযোগিতা করেন বন্ধু সাজিদ হাসান সজিব, নাজমুল হাসান আকাশ, মোস্তাহিদ আহমেদ, মাহিন মুর্তজা অনিকসহ আরও কয়েকজন বন্ধু ও সহপাঠী। বিভিন্ন এলাকায় খুঁজে শ্রমজীবীদের তথ্য ও যোগাযোগের নম্বর সংগ্রহ করেছেন। শুরুতে অনেকেই ইতিবাচক সাড়া দেননি। কথা বলে বোঝাতে হতো। এক বছর ধরে তথ্য সংগ্রহ করে অ্যাপটির ডেটাবেজ তৈরি করা হয়। এতে নিজেদের টিউশনি ও পকেট খরচের টাকা ব্যয় করেন।
রাজধানীর ৯০টি লোকেশনে শ্রমজীবী এবং পেশাজীবী মানুষের তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন তারা। বর্তমানে ২৮ হাজারের বেশি অ্যাপ ব্যবহারকারী ও ৩০০ থেকে ৪৫০ শ্রমজীবী মানুষ অ্যাপের সুবিধা পাচ্ছেন বিনামূল্যে। ভবিষ্যতে ডিজিটাল মানুষ অ্যাপের সুবিধা পাবেন দেশের সবাই। অ্যাপটি ব্যবহার করে অল্প কিছু ক্লিকের মাধ্যমে সহজে কাক্সিক্ষত সেবাদানকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন।
অ্যাপে প্রদত্ত কর্মীর ফোন নাম্বারে কল করে আপনার ঠিকানা জানাবেন। সমাধান হয়ে যাবে সমস্যার। সেবাদানকারী সম্পর্কে মতামত দিতে পারবেন অ্যাপের মাধ্যমে। এতে অন্যরা আপনার মতামত দেখে উন্নততর সেবা নিতে পারবেন।
আলিফ জানান, এটি আসলে শ্রমিকদের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। অ্যাপটিকে ২২টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ভাগ থেকে দরকারি কাজের কর্মী খুঁজে পাওয়া যাবে। এখন পর্যন্ত এতে রাজধানীর ৮৪ এলাকার কর্মীদের পাওয়া যাচ্ছে। নির্দিষ্ট এলাকা ‘লোকেশন’ হিসেবে নির্বাচন করলে অ্যাপে চলে আসছে সেখানকার শ্রমজীবীদের তালিকা। নাম, পরিচয় ও ফোন নম্বরের সঙ্গে আছে তাদের ভোটার আইডি কার্ড ও অভিজ্ঞতার তথ্য। অ্যাপে ‘কল’ বোতাম চাপলেই ফোনে আলাপ করা যাবে। সহজে সেই কর্মী এসে বাসার সমস্যা সমাধান করে দিতে পারবেন। পারিশ্রমিক ও অন্য ব্যাপারে নিজেরাই আলাপ করে নিতে পারবেন।
গত বছরের (২০১৭) ১ মে অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনের জন্য গুগল প্লে-স্টোরে উম্মুক্ত করা হয় ডিজিটাল মানুষ। https://goo.gl/xiXZ‡R লিংকে গিয়ে অ্যাপটি ডাউনলোড করা যায়।
আলিফ জানান, অ্যাপটি প্লে-স্টোরে ছাড়ার মাত্র ২২ দিনেই এটি পাঁচ হাজারের বেশি ডাউনলোড হয়েছে। প্রতিদিন ব্যবহারকারীরা শ্রমজীবী কর্মীর খোঁজে পাঁচশ’র বেশি কল করছেন।
ইতিমধ্যে কিছু পুরস্কার অর্জন করেছে ডিজিটাল মানুষ অ্যাপটি। এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ুথ কার্নিভালে সফটওয়্যার ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ডিজিটাল মানুষ অ্যাপ। ২০১৭ সালে সইরষষরড়হঃয ঝড়ঁঃয অংরধ অধিৎফ অর্জন করে।
আলিফের ভাষায়, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবেও মুক্তিযোদ্ধা বাবার মুখে শোনা বাস্তব আত্মত্যাগের গল্পগুলো থেকে দেশ ও মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন কাজ করত তার মধ্যে। সেই স্বপ্ন থেকেই ডিজিটাল মানুষ অ্যাপটি গড়ে তুলেছেন। তিনি মনে করেন, অ্যাপটি বাংলাদেশের বেকারত্বের হার কমিয়ে বাংলাদেশকে আরও উন্নত করবে বলে আশা করেন। দেশকে ডিজিটাল করার জন্য দেশের মানুষকে ডিজিটাল হতে হবে।