Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 2:21 am

বিনিয়োগ আকর্ষণে জরুরি নীতি সহায়তার ধারাবাহিকতা

নিজস্ব প্রতিবেদক: আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটে ব্যবসা সহায়ক পরিবেশের উন্নয়ন, নীতি সংস্কার ও নতুন নতুন নীতিমালা গ্রহণ, কর কাঠামোর সহজীকরণ, করপোরেট করের হার হ্রাস, সিএমএসএমই খাতের বিকাশ, পণ্য বহুমুখীকরণে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা প্রদান, টেকসই বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন, লজিস্টিক খাতের বিকাশে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। 

গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), দৈনিক সমকাল এবং চ্যানেল ২৪ আয়োজিত ‘প্রাক-বাজেট আলোচনা: প্রেক্ষিত বেসরকারি খাত’ শীর্ষক আলোচনায় তারা এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠনে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম এবং এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান। সমাপনী বক্তব্য দেন সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন।

স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান, আগামী বাজেটে লিস্টেড ও নন-লিস্টেড কোম্পানির করপোরেট কর হার ২.৫% হ্রাস, করপোরেট ডিভিডেন্ডের আয়ের ওপর বিদ্যমান ২০ শতাংশ করের পরিবর্তে ১০ শতাংশ কর নির্ধারণ এবং বার্ষিক টার্নওভারের ঊর্ধ্বসীমা ৪ কোটি টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেন।

এছাড়া প্রান্তিক বিনিয়োগ ও সঞ্চয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমানতের সুদ বাড়ানোর জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ব্যয় হ্রাস, সিএমএসএমই খাতের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ এবং এ খাতে বার্ষিক টার্নওভারের ভিত্তিতে ব্যাংক ঋণ প্রদান,

দেশের পুঁজিবাজারকে বিকশিত করতে সুসুকের মতো অন্যান্য সিকিউরিটাইজড বন্ড প্রবর্তন এবং গ্রিনফিল্ড অবকাঠমো প্রকল্পে পাঁচ বছরের জন্য কর অব্যাহতির প্রস্তাব করেন ডিসিসিআই সভাপতি।

তিনি চামড়া খাতে বন্ড লাইসেন্স প্রদানে দীর্ঘসূত্রতা হ্রাসকরণ, সম্ভাবনাময় নতুন শিল্প খাতের বিকাশের পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপিত শিল্পের জন্য বেজার লিজ রেন্টের ওপর ভ্যাট অব্যাহতির দাবি জানান।

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি দেশের বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে উৎসাহিতকরণ, লজিস্টিক নীতির দ্রুত বাস্তবায়ন এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় সব সেবা দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিশ্চিতকরণের প্রস্তাব করেন।

পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান, এমপি বলেন, আমাদের বেসরকারি খাতের উদ্যোম ও উদ্দীপনাই দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এলে সরকারের উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অজর্ন সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দেশের অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে ইতোমধ্যে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম গ্রহণ করেছে, যার সুফল শিগগিরই দেশবাসী ভোগ করতে পারবে।  

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী দেশের আগামীর ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়নে ‘ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ’ উন্নয়নের ওপর তিনি জোরারোপ করেন, যার মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় বিনিয়োগ বাড়বে।

তিনি উল্লেখ করেন, জার্মানি ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত। তাই আমাদের স্থানীয় এসএমই উদ্যোক্তাদের বিকাশের প্রতি আরও বেশি নজর দিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।

মো. শফিউল ইসলাম বলেন, করোনা মহামারি থেকে উত্তরণের জন্য সরকার প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদাণ করলেও অনেক সিএমএসএমই উদ্যোক্তা তা পাননি, এমতাবস্থায় আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ সহায়তা প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি করপোরেট কর হার হ্রাসকরণের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের আস্থা বৃদ্ধির জোরারোপ করেন। এছাড়া তিনি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে সম্পন্নের ওপর জোর দেন। যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমবে এবং প্রকল্প ব্যয় হ্রাস পাবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক আইনে যেকোনো পরিবর্তন ও পরিমার্জনের ক্ষেত্রে তিনি চেম্বার এবং অ্যাসোসিয়েশনগুলোর মতামত গ্রহণের ওপরও জোর দেন।

‘আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), ‘আর্থিক খাত’, ‘শিল্প ও বাণিজ্য’ এবং ‘অবকাঠামো’-এ চারটি সেশনের আলোচনায় দেশের বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

‘আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট)’ সেশনের আলোচনায় চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম, এমসিসিআই সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রাক্তন সদস্য মো. আলমগীর হোসেন বক্তব্য দেন।

এমসিসিআই সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম দেশের সার্বিক ট্যাক্স ও ভ্যাট কাঠামোকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার পাশাপাশি করোনা-পরবর্তী সময়ে প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।

এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. আলমগীর হোসেন রাজস্ব প্রশাসনে শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।

‘আর্থিক খাত’ সেশনের আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী নাসের এজাজ বিজয় এবং শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান আরিফ খান অংশগ্রহণ করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, করোনা মাহামারি মোকবিলায় শিল্প খাতের জন্য ইতোমধ্যে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সামনের দিনগুলোতে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় এ ধরনের আর্থিক ও নীতি সহায়তা অব্যাহত থাকবে।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী নাসের এজাজ বিজয় দেশের শিল্প খাতের বিকাশে এসএমইদের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ এবং সভরেন বন্ড চালুকরণের ওপর জোরারোপ করেন।

শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান আরিফ খান দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য পুঁজিবাজারকে শক্তিশালীকরণ, ভালো ভালো কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আসার জন্য উৎসাহিতকরণ এবং মিউচুয়াল ফান্ডের উন্নয়নের আহ্বান জানান।

‘শিল্প ও বাণিজ্য’ সেশনের আলোচনায় বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি মো. শহিদুল্লাহ আজিম, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল এবং ইফাদ গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসকিন আহমেদ অংশগ্রহণ করেন।

আলোচকরা জ্বালানি খাতে আমদানি নির্ভরতা কমানো, লজিস্টিক খাতের উন্নয়েন সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন এবং সেমি কনডাক্টার ইন্ডাস্ট্রির বিকাশে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদানের প্রস্তাব করেন।

সমাপনী বক্তব্যে সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাত অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাই আমাদের বিকাশমান অর্থনীতির আরও সম্প্রসারণে সরকারের উচিত বেসরকারি খাতকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা। তিনি সংবাদপত্র শিল্পের ওপর নির্ধারিত করপোরেট করের হার হ্রাসকরণ এবং নিউজপেপার আমদানির ওপর উৎসে কর ও ভ্যাট শিথিলের প্রস্তাব করেন।

সভায় ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি আরমান হক, সহ-সভাপতি মনোয়ার হোসেনসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।