Print Date & Time : 24 June 2025 Tuesday 4:03 pm

বিনিয়োগ আকর্ষণে সংস্কারের মানসিকতা আনয়নের আহ্বান

নিজস্ব প্রতিবেদক: গত বছর বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ক্ষেত্রে বড় ধরনের পতন হয়েছে। আর করোনার কারণে চলতি বছর বিশ্বব্যাপী এফডিআই প্রবাহ হ্রাস পেতে যাচ্ছে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিভিন্ন সংস্থা। এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে যাচ্ছে। তবে দেশে বিনিয়োগ আকর্ষণে বিভিন্ন ধরনের কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। এজন্য মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিয়োগের গতিপ্রবাহে কভিড-১৯-এর প্রভাব: সমস্যা ও উত্তরণ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এ ধরনের মন্তব্য করেন বক্তারা। গতকাল অনুষ্ঠিত এ ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী। এছাড়া ওয়েবিনারে অতিথি হিসেবে যোগদান করেন বাংলাদেশস্থ জাপান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত ইতো নায়োকি।

স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৯ দশমিক ছয় বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যদিও আমরা সে লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি। গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম খাতে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তিন দশমিক আট বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে, যেখানে মার্কিন বিনিয়োগের পরিমাণ তিন দশমিক ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

তিনি বলেন, ‘ওয়ার্ল্ড ইনেভেস্টমেন্ট রিপোর্ট, ২০২০’-এর তথ্যমতে, কভিড-১৯-এর কারণে ২০২০ সালে বৈশ্বিক বিনিয়োগ ৪০ শতাংশ কমে এক দশমিক ৫৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে এসে দাঁড়াতে পারে, যার ফলে আমাদের মতো উন্নয়নীল দেশে কভিড-পরবর্তী সময়ে বৈদেশিক বিনিয়োগ উল্লেখ্যযোগ্য হারে কমে যেতে পারে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি সময়োপযোগী সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন ও সংস্কার, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের আরও শক্তিশালী করার ওপর জোরারোপ করেন।

ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. এম মাশরুর রিয়াজ। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, আঙ্কটার্ডের তথ্যমতে, ২০২০ সালে বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রায় ৪০ শতাংশ হ্রাস এবং ২০২১ সালে হ্রাস পাওয়ার হার আরও পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যেখানে এশিয়া অঞ্চলের উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রায় ৪৫ শতাংশ কমে যেতে পারে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে নতুন পণ্য উৎপাদন, উদ্ভাবন, অবকাঠামো নির্মাণ, বাজার ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর আরো বেশি হারে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। এছাড়া প্রত্যাশিত বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে কমপ্লায়েন্স, দক্ষ মানবসম্পদ, পণ্য পরিবহনে সহজতর প্রক্রিয়া, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতিমালাগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যকার সমন্বয় বাড়ানো প্রভৃতি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।     

সালমান এফ রহমান বলেন, হ্রাসকৃত করের হার বিনিয়োগকারীদের নতুন বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে। তবে আমাদের দেশে কর-জিডিপি’র আনুপাতিক হার এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বনি¤œ। এক্ষেত্রে আমাদের বিদ্যমান করদাতাদের ওপর করের বোঝা না বাড়িয়ে নতুন করদাতা খোঁজার ওপর তিনি জোর দেন। উপদেষ্টা বলেন, সরকার নীতি সংস্কারের ওপর নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং নীতি সংস্কারের এ উদ্যোগ দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এরই মধ্যে বিনিয়োগ আকর্ষণে সংস্কারের মানসিকতা প্রয়োজনীয়তা সবার মাঝে চলে এসেছে, তবে এ বোধদয় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে, কারণ তাদের মাধ্যমেই নীতিগুলোর বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, এসইজেড অঞ্চলে খাদ্য ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাতে বিনিয়োগ করলে উদ্যোক্তারা ২০ শতাংশ ক্যাশ ইনশিয়েটিভ পাবে। মোটরসাইকেল নিবন্ধন ফি কমে ১০ শতাংশের নিচে আনা হবে। তিনি বেজা, বিডা ও হাইটেক পার্ক প্রভৃতি কর্তৃপক্ষের আরও ক্ষমতায়নের আহ্বান জানান। এছাড়া তিনি নীতিমালার সংস্কার ও বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো একান্ত আবশ্যক বলে মত প্রকাশ করেন। তবে তিনি বলেন, বেজা বিনিয়োগকারীদের জন্য অত্যন্ত কম মূল্যে জমি প্রদান করছে, যা ভিয়েতনামের তুলনায় অনেক কম। বাণিজ্য সম্প্রসারণে সম্ভাবনাময় দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মতামত ব্যক্ত করেন। উপরন্তু তিনি নতুন নতুন বন্দর স্থাপন এবং বন্দরগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। 

বাংলাদেশস্থ জাপান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত ইতো নায়োকি বলেন, জাপানি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী এবং ২০১৯ সালে এশিয়াতে জাপানি বিনিয়োগ ছিল ৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে বাংলাদেশে শূন্য দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ জাপানি বিনিয়োগ এসেছে। তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরভিত্তিক অর্থনীতি এবং এশীয় অঞ্চলে আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপনে জাপানের পক্ষ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে ট্যাক্সেশন, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ রিফর্ম অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা পরিচালনায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেই ভবিষ্যতে ব্যবসা সম্প্রসারণ ও আরও বেশি হারে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

ওয়েবিনারের নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন জোঅ্যান ওয়াগনার, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম, বিল্ডের চেয়ারম্যান আবুল কাসেম খান, জেট্রোর বাংলাদেশ আবাসিক প্রতিনিধি ইউজি এন্ডো, আব্দুল মোনেম লিমিটেডের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম মহিউদ্দিন মোনেম, অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ, স্যামসাং-ফেয়ার ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুহুল আলম আল মাহবুব প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।

জেট্রোর বাংলাদেশ আবাসিক প্রতিনিধি ইউজি এন্ডো বলেন, বর্তমানে ৩১০টি জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে, যা গত ১০ বছরে চারগুণ রেড়েছে। তিনি বলেন, কভিডের কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে সারা পৃথিবীতে ৩৩ শতাংশ জাপানি বিনিয়োগ কমেছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশকে করনীতিমালার সংস্কার ও আধুনিকায়ন, নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজতরকরণসহ সার্বিকভাবে বিনিয়োগ-সহায়ক পরিবেশ উন্নয়নে আরও বেশি গুরুত্বারোপের আহ্বান জানান।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম মনে করেন, জ্বালানি ও অবকাঠামোখাতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। বর্তমানে প্রবাসী বাংলাদেশিরা মিউচুয়্যাল ফান্ডে বিনিয়োগ করতে পারছে, যা একটি ইতিবাচক দিক। দেশের পুঁজিবাজারে বৈদেশিক বিনিয়োগের সংখ্যা বেশ আশাব্যঞ্জক।