ইসমাইল আলী:২০০৯ সাল থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত ১২৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। সরকারি, বেসরকারি বা দেশি-বিদেশি যৌথ অংশীদারিত্বে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে ১৯ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিতরণ সক্ষমতা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণের বেশি। এজন্য উৎপাদন ও বিতরণ খাতে সব মিলিয়ে বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরেও প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে।
যদিও এ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় প্রায় চারগুণ হয়েছে। তবে ভর্তুকি দিয়েও বিদ্যুতের দাম বেঁধে রাখা যায়নি। বরং গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়ে আড়াইগুণ হয়েছে। তবে এতকিছুর পরও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। জ্বালানি সংকটে জটিল হয়ে উঠেছে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি। বসে রয়েছে পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের বেশি সক্ষমতা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে এর পরিমাণ অনেক বেশি। এরই মধ্যে সর্বোচ্চ লোডশেডিং একাধিকবার রেকর্ড ভেঙেছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, ২০০৮ সালের শেষে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল মাত্র ২৭টি। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। গত এপ্রিলে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৫৩টি। এ সময় উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ১৪৭ মেগাওয়াট। যদিও এ সক্ষমতার প্রায় অর্ধেকই বসে থাকছে। গত এপ্রিলে দেশে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ১৪৩ মেগাওয়াট। ২০০৮ সাল পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল চার হাজার ১৩০ মেগাওয়াট।
উৎপাদনের পাশাপাশি বর্তমান সরকার বাড়িয়েছে সঞ্চালন ও বিতরণ সক্ষমতা। ২০০৮ সালের শেষে দেশে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ছিল আট হাজার সার্কিট কিলোমিটার, গত এপ্রিলে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৬৭২ সার্কিট কিলোমিটার। আর দুই লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটারের বিতরণ লাইন বেড়ে হয়েছে ৬ লাখ ২৯ হাজার কিলোমিটার। একইভাবে বেড়েছে গ্রিড উপকেন্দ্রের সক্ষমতা। ২০০৮ সালের শেষে এর পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৮৭০ মেগাভোল্ট অ্যাম্পিয়ার (এমভিএ), বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৬১ হাজার ৪১২ এমভিএ।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালন সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে গত সাড়ে ১৪ বছরে বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৫৮টি এবং যৌথ উদ্যোগের দুটি। এ ৬০টি কেন্দ্র এবং সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে গিয়ে বিনিয়োগ করতে হয়েছে প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলার। আর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৯৩টি। এগুলোর জন্য বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে প্রায় সাড়ে ১৪ বছরে বিদ্যুৎ গ্রাহক এক লাখ আট হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে চার লাখ ৫০ হাজার। আর সেচ গ্রাহক দুই লাখ ৩৪ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৭৩ হাজার। তবে এ সময় বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ও অনেক বেড়ে গেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ছিল দুই টাকা ৬১ পয়সা। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ১০ টাকা ৯৩ পয়সা। বিদ্যুতের এ উচ্চ ব্যয়ের চাপ সামাল দিতে এ সময়ে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে এক লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। যদিও এর মধ্যে ঋণ হিসেবে দেয়া হয় ৪৩ হাজার ১৬০ কোটি ১২ লাখ টাকা। বাকিটা সরাসরি ভর্তুকি হিসেবে দেয়া হয়। তবে লোকসানি পিডিবি সে ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। এজন্য ঋণকে ভর্তুকিতে রূপান্তরের জন্য কয়েক দফা অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠিও দেয়া হয়েছে।
ভর্তুকির হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি দেয়া হয় চার হাজার কোটি টাকা। আর শেষ হতে যাওয়া অর্থবছরে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে গত মে পর্যন্ত ২৩ হাজার কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছরের জন্য আরও চার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিয়েছে পিডিবি। তবে উচ্চ ভর্তুকি দিয়েও সামাল দেয়া যায়নি বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ের পুরোটা। এজন্য কয়েক দফা বাড়ানো হয় বাল্ক (পাইকারি) ও গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমান সরকারের আমলে ১৪ বছরে ১০ বার বাল্ক মূল্যহার বাড়ানো হয়েছে ও একবার কমানো হয়েছিল। বিদ্যুতের বাল্ক মূল্য ২০০৮ সালের অক্টোবরে ছিল ২.৩৭ টাকা, বর্তমানে তা ৬.৭০ টাকা। এর মধ্যে গত ডিসেম্বরে প্রায় ২০ শতাংশ ও ফেব্রুয়ারিতে আট শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। একইভাবে গ্রাহক পর্যায়েও বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। ২০০৯ সালের শুরুতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ছিল ৩.৭৩ টাকা, বর্তমানে তা ৮.২৫ টাকা। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে টানা তিন দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়।
এতকিছুর পরও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত হয়নি। জ্বালানি তেল ও গ্যাস সংকটের কারণে গত বছর জুলাই থেকে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক লোডশেডিং। ঘোষণা দিয়ে সে সময় শুরু করা লোডশেডিং চলে নভেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যে ৮ অক্টোবর সর্বোচ্চ দুই হাজার ১০৭ মেগাওয়াট রেকর্ড লোডশেডিং হয়েছিল। শীত আসার কারণে তাপমাত্রা কমতে থাকলে নভেম্বরের শেষদিকে লোডশেডিং শূন্যে নামে। যদিও জানুয়ারির পৌষেই সীমিত আকারে লোডশেডিং ফিরে আসে। তবে মার্চে তা বাড়তে শুরু করে ও এপ্রিলে ব্যাপক আকার ধারণ করে।
জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দেয়ায় এপ্রিলে রোজার মধ্যে রেকর্ড লোডশেডিং হয়। তবে ওই সময় সন্ধ্যার দিকে উৎপাদন বাড়িয়ে টানা তিন দফা সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড করা হয়। তবে বৃষ্টি আসায় মে মাসে লোডশেডিং কমলেও জুনে তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এরই মধ্যে গত সাত দিনে তিন দফা লোডশেডিংয়ের রেকর্ড ভেঙেছে। এর মধ্যে ৬ জুন সর্বোচ্চ তিন হাজার ২৮৭ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাপমাত্রা না কমলে আপাতত লোডশেডিং থেকে মুক্তির সম্ভাবনা নেই। কারণ জ্বালানি সংকটে ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এতে পিক আওয়ারেও বসিয়ে রাখতে হচ্ছে পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের বেশি সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লা সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের সর্ববৃহৎ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লাভিত্তিক অপর দুই বিদ্যুৎকেন্দ্র রামপাল ও বরিশালও জ্বালানি সংকটে ধুঁকছে। আবার বিল পরিশোধ না করায় ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলো তেল আমদানি করতে পারছে না। এতে সেগুলোর সক্ষমতার বড় অংশ বসে রয়েছে। আবার সঞ্চালন লাইনের ত্রুটিতে গতকাল ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডা থেকে আদানির বিদ্যুৎ আসা বন্ধ হয়ে যায়।
এ অবস্থায় কবে নাগাদ বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তা কেউ বলতে পারছে না। যদিও লোডশেডিং পরিস্থিতি ঠিক হতে আরও দুই সপ্তাহ লাগতে পারে বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সম্প্রতি তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে গ্রাহকরা দেখছেন যে লোডশেডিং বেড়ে গেছে। জ্বালানি হিসেবে গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেলের জোগান দিতে কষ্ট হচ্ছিল। এ কারণে লোডশেডিং ধীরে ধীরে বেড়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। তবে দ্রুত কয়লা আনার চেষ্টা চলছে। এছাড়া জ্বালানি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে। এগুলো দ্রুত সমাধানে বিদ্যুৎ বিভাগ চেষ্টা করছে। তাপপ্রবাহ চলছে, তাই বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে গেছে। আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। তবে ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে।