Print Date & Time : 27 June 2025 Friday 3:43 pm

বিনিয়োগের বিকল্পগুলো

মিজানুর রহমান শেলী: এসব বিনিয়োগ নীতিগুলো বাফেটের জীবন্ত রচনাগুলোয় ফুটে উঠেছে। এখানে বিনিয়োগের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। উৎপাদনশীল সম্পদে তিনি বিনিয়োগ করেছিলেন। এসব বিনিয়োগে তার কর্মনৈপুণ্যতা তিনি তার রচনার প্রথমেই আলোকপাত করেছেন। আর উৎপাদনশীল সম্পদে বিনিয়োগের অর্থটাই বা কী সেটার ব্যাখ্যাও তিনি প্রথমেই দিয়েছেন। বিভিন্ন ধারাবাহিক রচনায় এসব বিচিত্র সুযোগগুলো বিধৃত হয়েছে। একেবারেই শূন্য থেকে তিনি শুরু করেছেন তার আলোচনা। তিনি জিরো-কুপন বন্ডের আলোচনা করেছেন আবার স্টক মার্কেটের আলোচনাকে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। ওয়াল স্ট্রিট ও একাডেমি উভয় পক্ষকেই তিনি তার কৌশলগত তত্ত্বীয় আলোচনায় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। তিনি গ্রাহামের ধারণাকে সামনে নিয়ে এসেছেন। কেননা, তিনি ‘ড্যাগার থিসিস’কে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই ড্যাগার থিসিসে জাঙ্ক বন্ডকে (উচ্চ-ফলপ্রসূ ও উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ সিকিউরিটি। সাধারণত কোনো কোম্পানি কর্তৃক এই বন্ড ইস্যু করা হয়। কোনো কোম্পানি যখন খুব দ্রুত পুঁজি আহরণের চেষ্টা করে তখন এই জাঙ্ক বন্ড ইস্যু করে থাকে) সংজ্ঞায়িত করে। ড্যাগার থিসিসÑএটা একটি রূপক নাম। একজন মোটরগাড়ি চালককে নিবিড়ভাবে দেখভাল করার বিষয়টিকে এখানে রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে একজন মোটরগাড়িচালক যখন তার স্টিয়ারিং হুইলের সামনে একটি ড্যাগার বা চাকু খাড়া হয়ে থাকতে দেখেন, তখন তিনি যে সংকট অনুভব করেন, সেই একই সংকটে পড়েন একজন ব্যবস্থাপক যখন তার পুঁজি কাঠামোর মধ্য থাকে বিপুল পরিমাণে ঋণের অর্থ। আর এ বিষয়টি ড্যাগার থিসিসের মতো শাস্ত্রীয় প্রভাবের ফসল।
বাফেট বহুসংখ্যক করপোরেশনের কথা বলেছেন যারা ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকের মন্দা পরিস্থিতিতে পর্যুদস্ত হয়েছিল ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে। এর মাধ্যমে তিনি একাডেমিক রিসার্চের অসারতা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি দেখিয়েছেন নিজেদের অক্ষমতাজনিত সর্বোচ্চ খেসারতের চেয়ে অনেক বেশি খেসারত দিতে হয় জাঙ্ক বন্ডের মতো উচ্চতর সুদের হারের কারণে। পরিসংখ্যানের প্রথম বর্ষের ছাত্রদের দ্বিধান্বিত ধারণার কাছে এসব ভ্রান্ত কৌশলের স্বীকৃতি এসেছিল। সেই ঐতিহাসিক পরিস্থিতি তাদের শিক্ষা জীবনেই ঘটেছিল। আবার ভবিষ্যতেও ফিরে আসতে পারে। কিন্তু তারা একই ভুল আর করেনি। কিন্তু আবার সেই জাঙ্ক বন্ডের মতো মূর্খতাকে আলোর মুখ দেখাতে চার্লি মাঙ্গার রচনা লিখলেন। এই রচনায় মাইকেল মিলকেনের ‘এপ্রোচ টু ফাইন্যান্স’ নিয়ে আলোচনা করেছে।
রাজস্ব আহরণে সক্ষম যত ধারণা আছে তা ওয়াল স্ট্রিট লুফে নেয়। কিন্তু ফাইন্যান্সিয়াল ধারণা থেকে কোনো কিছু তারা গুরুত্ব দেয় না। এ প্রবণতা প্রায়ই ভালো ধারণাগুলোকে নষ্ট করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, জিরো কুপন বন্ডের যুগে তারা ক্রেতাদের কম্পাউন্ড রিটার্নের মধ্যে আটকে ফেলতে পারত, যা আবার কুপনের মূল দরের সমান। ফলে একটি সাধারণ বন্ডের পেছনে তাদের পিরিয়ডিক ইন্টারেস্ট (সাময়িক সুদ) পরিশোধ করতে হতো না। তাই একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জিরো কুপন ব্যবহার করে একজন ধারকারী আরও বেশি ধার করতে পারত। ফলে ইন্টারেস্ট এক্সপেন্স পরিশোধ করতে তাকে কোনো বাড়তি ফ্রি ক্যাশ ফ্লো (এফসিএফ) প্রয়োজন হতো না। কিন্তু তখনই সংকট দানা বেঁধে উঠল, যখন দুর্বলরা জিরো-কুপন বন্ড ইস্যু করতে শুরু করল; অথচ এদের ঋণের দায়বদ্ধতা বাড়তে বাড়তে ফ্রি ক্যাশ ফ্লো (এফসিএফ) আর অবশিষ্ট ছিল না। বাফেট কটাক্ষ করে বলেন, ‘ওয়াল স্ট্রিটে প্রায়ই যা ঘটত, তার শুরুটা হতো বিচক্ষণতার আর শেষটা হতো মূর্খতার।’
২০০৮ সালের সংকটে অনেক অভিযুক্ত ব্যক্তির হাত রয়েছে। তারা ডেরিভেটিভ ফাইন্যান্সিয়াল উপাদানগুলো এখানে ছড়িয়ে দিয়েছিল। আর এ কথা কয়েক বছর আগেই বাফেট তার রচনায় উল্লেখ করেন এবং এ বিষয় সতর্ক হওয়ার কথা বলেন। সাম্প্রতিক কালের ফাইন্যান্সিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং জটিল জটিল উপাদানের যেন এক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছেন। এটাই ডেরিভেটিভ ফাইন্যান্স বলে পরিচিত। কেননা তাদের অস্থির মূল্যমান চুক্তিভিত্তিক বেঞ্চমার্ক থেকে উদ্ভূত। প্রবক্তারা বিশ্বাস করেন, এসব কৌশলাদি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য উপযোগী। আর বার্কশায়ার মাঝে মাঝে ডেরিভেটিভস চুক্তিগুলোর মধ্যে পরিমিত অবস্থান গ্রহণ করে: বাফেট এটাকে মিস-প্রাইসড (আপিওতে কোনো কোম্পানি পাবলিক হওয়ার সময় নিরাপত্তার মান, পণ্য বা সেবার দাম যদি সঠিকভাবে স্বকীয় মূল্যের সঙ্গে মানানসই না হয়) হিসেবে বিবেচনা করেন। আবার প্রবক্তারা যখন বিশ্বাস করেন এই ডেরিভেটিভস সামগ্রিক সিস্টেমেটিক ঝুঁকি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রবণতা দেখায়, তখন বাফেট তার দূরদৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণে দেখেন এই ডেরিভেটিভস কার্যত এর উল্টো প্রভাবও দেখাতে পারে। এগুলোর মূল্যমান নির্ণয় করা কঠিন, খুব দ্রুততার সঙ্গে এর মূল্যমান পরিবর্তন হতে পারে। এগুলো বিভিন্ন ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করতে পারে এবং একে অন্যের মধ্যে একটি আন্তঃনির্ভরশীলতা তৈরি হয়। বাফেট সতর্ক করে বলেন, এসব ফ্যাক্টরগুলোর সমন্বয়ে কোনো একটি খাতে যে কোনো একটি ঘটনা ঘটে, যা ওই খাতের জন্য নানামুখী চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। আবার এই চ্যালেঞ্জগুলো অন্যান্য খাতের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে দ্রুততার সঙ্গে। এ সময় সঙ্গী হয় ডমিনো ইফেক্ট (ডমিনো তত্ত্বের প্রভাব); যা বিধ্বংসী এক প্রণালিবদ্ধ পরিণতি বয়ে আনে। এটা ২০০৮ সালে ঘটে যাওয়া এক বাস্তবতার কেইস স্টাডি।
বাফেট তার ‘ডেরিভেটিভস রিস্কস’ মতামতটাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ব্যাখ্যা করে বলেছেন, যে কোনো প্রকার মেগা-ক্যাটাস্ট্রফি রিস্কের প্রতি তার বিতৃষ্ণার কারণে ডেরিভেটিভস রিস্কস প্রভাবিত হতে পারে। এটা বার্কশায়ারের ফিন্যান্সিয়াল ভিত্তি কাঠামোকে বিপন্ন করেছিল। আসলে এটা বাফেটের ‘আরামকেদারা মতামত’ নয়। বরং তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত। কার্যত, বাফেট কয়েক বছর ধরে ডেরিভেটিভ ডিলারশিপ ব্যবস্থাপনায় প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। সেই বাস্তব অভিজ্ঞতা তার ছিল। বার্কশায়ার যখন জেন রে রিইন্স্যুরেন্স কোম্পানিটি অধিগ্রহণ করে, তখনই তিনি ডেরিভেটিভ ডিলারশিপের ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। বাফেট ব্যবসার মন্দাভাবের ধারাবাহিকতা নিয়ে বিশ্লেষণ দাঁড় করাননি, বরং তিনি উল্লেখ করেছেন কীভাবে এটা বিক্রি করা সম্ভব হয়েছিল এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি দায়বদ্ধতার গোলকধাঁধায় তাকে আটকে পড়তে হয়েছিল। ফলে কয়েক বছরের একটি বেদনাদায়ক পরিস্থিতি সহ্য করতে হয়েছিল। বার্কশায়ারের এই অভিজ্ঞতা থেকে বাফেট একটি চিন্তা প্রসূত শিক্ষা লাভের আহ্বান জানিয়েছেন অন্যদের।
বাফেটের রচনাবলির এই অংশের উপসংহারে বিভিন্ন সামষ্টিক অর্থনীতির শিক্ষাগুলো আলোচনা করা হয়েছে। এ আলোচনা যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘাটতি থেকে শুরু করে বাড়ির মালিকানাবিষয়ক জাতীয় নীতিমালা পর্যন্ত পরিব্যপ্ত হয়েছে। উল্লেখ্য, বাড়ির মালিকানা বা হোম ওনারশিপ ২০০৮ সালের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসে ভূমিকা রেখেছিল।

এই দর্শন রচনাবলি সম্পাদনা করেছেন লরেন্স এ. কানিংহ্যাম।
অনুবাদক: গবেষক, শেয়ার বিজ।