বিপণন (মার্কেটিং) শব্দটি আমাদের কাছে বেশ পরিচিত একটি শব্দ। সময়ের সঙ্গে বিপণন ব্যবসার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায় শক্তপোক্ত অবস্থান করে নিতে যথাযথ বিপণন কৌশলের বিকল্প নেই। বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর দিকে বিশ্ববাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের সেরা বিপণন কৌশল দিয়েই। তাই বর্তমানে কোম্পানিগুলো তাদের বড় একটি বিনিয়োগ করে এ খাতে। বিপণন ধারণার সৃষ্টি ল্যাটিন শব্দ গধৎপধঃঁং থেকে ইংরেজি গধৎশবঃ শব্দের উৎপত্তি। এ গধৎশবঃ শব্দ থেকে পরে গধৎশবঃরহম শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। যার বাংলা প্রতিশব্দ হলো বিপণন বা বাজারজাতকরণ। সরল ভাষায়, মার্কেটিং হলো একটি বিনিময় প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সন্তুষ্টির সঙ্গে ভোক্তার প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণ হয় এবং প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণের মাধ্যমে ভোক্তা সন্তুষ্টির সঙ্গে স্থায়ী ভোক্তায় পরিণত করার চেষ্টা চালানো হয়। মানুষ অনেক আগে থেকেই নিজেদের অজান্তেই বিপণনের ধারণা বাস্তবিক প্রয়োগ শুরু করে। ইতিহাস দেখলে আমরা জানতে পারি মেসোপটেমিয়ার সমাজগুলো প্রধানত গুণমান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপক উৎপাদন শুরু করেছিল। ক্রেতাদের যাতে তাদের পণ্য চিনতে সুবিধা হয়ে সে কারণে তারা পণ্যে গায়ে লোগো বা স্বাক্ষর চিহ্ন ব্যবহার করত। আর এ লোগো দেখেই ক্রেতারা তাদের সেই পণ্যগুলো চিনতে পারতেন এবং ক্রয় করতেন। প্রাচীন রোমান অস্ত্র নির্মাতারা তাদের তৈরি অস্ত্র যাতে আলাদাভাবে চেনা যায়। তাই অস্ত্রের ওপরে তাদের বিশেষ চিহ্নের ব্যবহার করত। মূলত ১৯৫০-এর মাঝামাঝি সময়ে বিপণন মতবাদের উদ্ভব হয়। আদিমকালে মানুষ পশু শিকার করে গাছের ফলমূল খেয়ে জীবনধারণ করত। তারপর মানুষ আগুন জ্বালাতে শেখে। তারপরে মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে শুরু করে। নিজেদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করে চাহিদা মেটাতে শুরু করে। পণ্য বিনিময় প্রথার মাধ্যমে মানুষ একে অপরের চাহিদা মেটাতে শুরু করে। তারপর বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে প্রচলন হয় মুদ্রার। ১৭৬০ থেকে ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালে শিল্প বিপ্লব উৎপাদন ব্যবস্থায় আনে আমূল পরিবর্তন। পরিবারকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে বৃহৎ পরিসরে উৎপাদন শুরু হয়। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কার ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। এছাড়া বিভিন্ন খনিজ সম্পদের ব্যবহার যেমন জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার উৎপাদন ব্যবস্থাকে গড়ে তুলে আরও বেগবান। তবে তখনো একটি প্রতিষ্ঠান এক ধরনের পণ্য তৈরি করত। চাহিদার তুলনায় পণ্য সীমিত উৎপাদন হওয়ায় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা অর্জনকে বেশি প্রাধান্য দিত। ধীরে ধীরে যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন, যাতায়াত ব্যবস্থা গতিবৃদ্ধি, বিশ্বায়নের ফলে ব্যাপকহারে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। একই ধরনের পণ্য উৎপাদন করতে থাকে কয়েকটি কোম্পানি। ভোক্তাদের চাহিদা তুলনার পণ্যের প্রাপ্যতা বেশি হওয়ায় বাজারে দেখা দেয় তীব্র প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতায় টিকতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য থেকে বের হয়ে ক্রেতা সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে বিক্রয় বৃদ্ধির চেষ্টা করতে থাকে। পণ্য শুধু উৎপাদন করলে তো হবে না, পণ্য অবশ্যই ভোক্তার চাহিদা পূরণের সক্ষমতা থাকতে হবে। তাই ভোক্তার চাহিদা নিয়ে শুরু হয় গবেষণা। পণ্য বিক্রি করতে হলে পণ্য সম্পর্কে ভোক্তাদের জানাতে হবে সে ধারণা থেকে শুরু হয় বিজ্ঞাপনের। দেয়াল লিখন, বিলবোর্ড, পোস্টার, সংবাদপত্র, টেলিভিশনের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো আমাদের তাদের পণ্য ক্রয়ে আগ্রহী গড়ে তোলার নিয়মিত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এবার প্রশ্ন হলো মার্কেটিংয়ের প্রকৃত সুবিধাভোগী কারা? এর দ্বারা কী ভোক্তা কোনো সুফল পেয়েছে? অবশ্যই যথাযথ বিপণন কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো ভালো ব্যবসায়িক সুবিধা লাভ করে সত্যি তবে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে মার্কেটিংয়ের অবদান অনস্বীকার্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে মানুষের চাহিদা। কোম্পানিগুলোও তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আনছে উন্নতমানের পণ্য। মানুষের চাহিদা নিয়ে চলছে ব্যাপক গবেষণা। মানুষের জীবনযাত্রার মান সহজ করতে বাজারে আসছে নতুন নতুন পণ্য। এক সময় যে মোবাইলফোন কথা বলার মাধ্যম ছিল আজ সে মোবাইল ফোনে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ি, ক্যালেন্ডার, ক্যালকুলেটর, মেসেজিং, ইন্টারনেটসহ আরও কত কী। কোম্পানিগুলোর চেষ্টা কীভাবে অল্প দামে ভালো পণ্য ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে ব্যবসায় টিকে থাকবে। মার্কেটিং ধারণার উদ্ভবের পর থেকে বিক্রেতারা লাভে নয়, ভোক্তা সন্তুষ্টি অর্জনের দিকে বেশি ধাবিত হচ্ছে। তাই বিপণন শুধু ব্যবসায়িক সফলতা লাভে সাহায্য করে তা নয়; এটি জীবনযাত্রার মানোন্নয়েও ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে।
মো. তাজুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, বিপণন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়