বিপর্যয়ে যশোরের মাছচাষি ও হ্যাচারি মালিকরা

মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: পঞ্জিকার হিসেবে চলছে বর্ষাকাল। আষাঢ় শেষ হয়ে শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহ পার হলেও বৃষ্টির দেখা নেই। দীর্ঘ অনাবৃষ্টি আর সূর্যের খরতাপে প্রচণ্ড দাবদাহে বছর যশোরের মাছচাষিদের জন্য নিয়ে এসেছে এক অশুভ বার্তা। কাক্সিক্ষত বৃষ্টি না হওয়ায় পুকুরে রেণু পোনা ছাড়া সম্ভব হচ্ছে না। রেণু ও পোনা উৎপাদন ও বিক্রির মৌসুম শেষ হতে চললেও বৃষ্টির অভাবে ভরা মৌসুমেও জমছে না যশোরের চাঁচড়া মৎস্যপল্লীর রেণু ও পোনা বিক্রির বাজার। চরম সংকটের মুখে পড়েছেন মাছচাষি ও হ্যাচারি মালিকরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের স্বাদু পানির মাছ চাষে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।

মূলত জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই রেণু ও পোনা বিক্রির মৌসুম শুরু হয়, যা আষাঢ়ের মাঝামাঝি সময়ে পুরোদমে জমে ওঠে। বছরের এমন সময়ে মাছের রেণু ও পোনা চাষের রাজধানী হিসেবে খ্যাত যশোরের চাঁচড়ার মৎস্যপল্লীতে ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়ে মুখর হয়ে ওঠে। কিন্তু এ বছর আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহ পার হতে চললেও পানির অভাবে খাল-বিল, পুকুর, জলাশয় খাঁ খাঁ করছে। পর্যাপ্ত পানির অভাব ও তীব্র খরতাপের কারণে মাছের পোনা পুকুরে দিতে পারছেন না মাছচাষিরা। ক্রেতাশূন্য যশোরের চাঁচড়া মৎস্যপল্লী। এ অবস্থা চলতে থাকলে মাছ চাষের রাজধানী হিসেবে খ্যাত যশোরে স্বাদু পানির মাছ উৎপাদন কমে যেতে পারে, যা গোটা দেশের মাছ চাষের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পাওে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মৎস্য বিভাগের সূত্রে জানা গেছে, যশোর জেলায় প্রায় দেড় লাখ মানুষ সরাসরি মাছ চাষে নিয়োজিত। এ জেলায় ১৩ হাজার ৬২৬ হেক্টর জলায়তন বিশিষ্ট পুকুর রয়েছে। বাঁওড় রয়েছে ১৩ হাজার ৩৯১ হেক্টর। যশোর সদর উপজেলায় সাদা মাছ ও পাঙাশ রেণু উৎপাদন করছে ৩৪টি হ্যাচারি। আর পুরো জেলাজুড়ে এমন হ্যাচারির সংখ্যা ১২০টি। এসব খামারে রেণু উৎপাদন হয় ৫৪ হাজার ২০০ কেজি, যা থেকে পোনা উৎপাদন হয় প্রায় ৪৮ কোটি ৩৭ লাখ।

মাছচাষিরা জানান, ব্রুড স্বল্পতা, পুকুর বা জলাশয়ের লিজ মূল্য বৃদ্ধি, সার ও মাছের খাবারের দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি ও দেশের অন্যত্র মাছের হ্যাচারি গড়ে ওঠায় এমনিতে চাঁচড়ার মৎস্য খামারিরা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে চলে আসছে। এসব কারণে বর্তমানে চালু রয়েছে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫টি হ্যাচারি। কিন্তু গত দুই বছর থেকে দেশে করোনার প্রভাবের কারণে তারা চরম ক্ষতির মুখে পড়তে থাকেন। এ বছর করোনা পরিস্থিতি মাছ চাষের জন্য বাধা না হলেও বিপত্তি দেখা দিয়ে তীব্র পানি সংকট ও তাপদাহ। এ পরিস্থিতিতে চালু হ্যাচারির মালিকরাও অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন। রেণু ও পোনা বিক্রির মৌসুম শেষ হতে চললেও বৃষ্টির অভাবে তারা চারা বিক্রি করতে পারছেন না।

হ্যাচারি মালিক অহিদুল্লাহ লুলু জানান, বৃহত্তর বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা ও যশোর জেলায় সর্বত্র যে রেণু পোনার চাহিদা রয়েছে তা চাঁচড়া থেকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। যশোরে যত জাতের রেণু উৎপাদিত হয় দেশের অন্য কোনো হ্যাচারিতে এত জাতের রেণু উৎপাদন হয় না। বিশেজ্ঞদের মতে যশোরের মাটি ও পানি রেণু উৎপাদনের জন্য দেশের মধ্যে সেরা। এজন্য প্রতি বছর মৌসুম এলে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রেণুু ও পোনা কিনতে ব্যবসায়ীরা আসেন। কিন্তু এ বছর তার কোনো আলামত নেই। পুকুর জলাশয়ে পানি না থাকায় ব্যবসায়ীরা আসছেন না। তিনি বলেন, এখনও যদি বৃষ্টিপাত হয় তাহলে কিছুটা পুঁজি রক্ষা করতে পারব আমরা।

যশোর জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী ও হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ ফিরোজ খান বলেন,  বর্তমান সময়টা আমাদের খুব খারাপ যাচ্ছে। অন্যান্য বছরে মার্চের পর থেকেই আমরা বেচাকেনা শুরু করে দেই। কিন্তু এ বছর জুলাই শেষ হতে চললেও মাছের রেণু ও পোনা বিক্রি করতে পারছি না। তিনি বলেন, প্রকৃতির এ পরিস্থিতির পাশাপাশি বিদ্যুতের বিষয়টি নিয়ে আমরা বেশ সমস্যায় আছি। প্রতিটি হ্যাচারি মালিককেই শিল্প রেটে বিদ্যুৎ বিল গুনতে হচ্ছে। তারপর বর্তমান বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে শুরু হয়েছে লোডশেডিংয়ের শিডিউল।

যশোর জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী ও হ্যাচারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান গোলদার বলেন, দীর্ঘ বৃষ্টিহীনতার কারণে চাঁচড়ায় মাছের রেণু ও পোনা বিক্রি শূন্যের কোঠায় নেমেছে। দেশের পুকুর-খাল-বিলে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা যশোরে আসছেন না। যে কারণে আমরা এ বছর চরম লোকসানের কবলে রয়েছি। অনাবৃষ্টির কারণে আমাদের উৎপাদন প্রায় বন্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতিতে অনেক মাছ ব্যবসায়ীর পথে বসে যাবে বলে আমরা মনে করছি। 

যশোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফিরোজ আহম্মেদ বলেন, সহসা বৃষ্টি না হলে এ বছর যশোরে মাছ উৎপাদনে ব্যাহত হবে। তবে আমরা আশা করছি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ভারী বৃষ্টি হলে মাছচাষিরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। তিনি বলেন, আবহাওয়ার এমন দীর্ঘ বৈরী পরিস্থিতি হবে এমনটা আমরা কেউই আন্দাজ করতে পারেনি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০