নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে বসবাসকারী প্রায় ১৭ কোটি জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ ভূ-ভাগে পর্যাপ্ত পরিমাণে অনুপস্থিত। এক্ষেত্রে মানুষের প্রয়োজনীয় সম্পদের জোগান নিশ্চিত করার অপার সম্ভাবনা রয়েছে দেশের সমুদ্রসীমায়। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ সমুদ্রসম্পদ কাজে লাগিয়ে অনেক অগ্রগতি সাধন করেছে। কিন্তু সেই তুলনায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ সমুদ্র সীমার মধ্যে মাত্র ৩০-৪০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত মাছ শিকার করা হয়। এর বাইরে সমুদ্রে যে বিপুল সম্পদ রয়েছে, তা আহরণের জন্য বাংলাদেশ এখনও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। ফলে সম্ভাবনাময় সুনীল অর্থনীতি বা ব্ল–-ইকোনমি একপ্রকার গুরুত্বহীন থেকে যাচ্ছে।
‘প্রমোট সাসটেইনেবল ব্ল– ইনভেস্টমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক জাতীয় কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি), জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও জাতিসংঘের পরিবেশ-সংক্রান্ত কর্মসূচি (ইউএনইপি) যৌথভাবে এ কর্মশালা আয়োজন করে। সাভারের ব্র্যাক সিডিএমে এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক জুয়েনা আজিজ। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জিয়াউল হাসান, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়াল অ্যাডমিরাল (অব.) খোরশেদ আলম। অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর রিয়াল অ্যাডমিরাল (অব.) এম খালিদ ইকবাল। সভাপতিত্ব করেন জিইডির সদস্য (সচিব) ড. মো. কাউসার আহাম্মদ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের প্রধান কারিগরি পরামর্শক ফকরুল আহসান ও সংস্থাটির অর্থনীতিবিদ জোবায়ের হোসেন।
খোরশেদ আলম বলেন, সারাবিশ্বে সমুদ্র দিয়ে প্রায় দেড় লাখ জাহাজ যাতায়াত করে। এগুলো প্রায় ১১ বিলিয়ন টন মালামাল এক দেশ থেকে আরেক দেশে পরিবহন করা হয়। সেখানে বাংলাদেশের জাহাদ আছে মাত্র ৮০টি। বাংলাদেশে যে পরিমাণ আমদানি হয়, এতে প্রায় ৫ হাজার জাহাজ লাগে। এগুলোর পেছনে জাহাজ ভাড়া দিতেই প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। নিজেদের জাহাজ থাকলে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে সমুদ্র বন্দর বলা হলেও এগুলো প্রকৃতপক্ষে নদীবন্দর। কারণ এর চ্যানেলগুলো নদীভিত্তিক। এখন মাতারবাড়ীতে একটি সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেটা চালু হলে বাংলাদেশের প্রকৃত সমুদ্রবন্দর চালু হবে।
সমুদ্র থেকে বিপুল পরিমাণ মৎস্য সম্পদ আহরণের সুযোগ থাকলেও বড় ফিশিং ট্রলারের অভাবে বাংলাদেশ সে সম্পদ আহরণ করতে পারছে না বলে বক্তারা জানান। বাংলাদেশ ২০১২ সালে সমুদ্র সীমা জয় করলেও এখনও পর্যন্ত সমুদ্রসীমায় কোনো অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু হয়নি। এমনি সমুদ্রে যে ২২টি ব্লক রয়েছে, সেখান থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস বা অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের জন্য এখনও পর্যন্ত ভূকম্পন জরিপই সম্পন্ন করা হয়নি। ফলে তেল ও গ্যাস উত্তোলন বা মজুদের বিষয়ে কোনো তথ্য জানা যাচ্ছে না।
বক্তারা জানান, সমুদ্র পর্যটনেও অনেক পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ সম্ভাবনা কাজে না লাগার জন্য দেশের বিদ্যমান নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দায়ী বলে বক্তারা
উল্লেখ করেন। তাছাড়া সমুদ্রে যে সম্পদের ভাণ্ডার রয়েছে, সেগুলোর কার্যকর ব্যবহারে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারের একার পক্ষে এত বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়। তাই বিনিয়োগ করার জন্য বেসরকারি খাতকে আকৃষ্ট করতে হবে। কিন্তু সুনীল অর্থনীতির প্রতি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করার জন্য এখনও পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। পাশাপাশি সমুদ্র সম্পদ আহরণের জন্য মেরিটাইম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। এক্ষেত্রে আরও যেসব চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান তা হলোÑপ্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব, সমুদ্রে নিরাপত্তার অভাব, সমুন্দ্র বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞানের স্বল্পতা, সঠিক তথ্যের অভাব, গবেষণা না থাকা, পর্যান্ত বাজেট বরাদ্দ না থাকা এবং বেসরকারি খাতের বিশ্বাস ও আস্থাহীনতা।
বক্তারা আরও বলেন, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেসরকারি খাতকে আস্থা ও বিশ্বাস দিতে হবে। কেননা পর্যটনের ক্ষেত্রে একজন পর্যটক এলে সরাসরি কর্মসংস্থান হয় ১১ জনের। আর পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয় ৩৩ জনের। পর্যটন খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে মৎস্য আহরণ থেকে শুরু করে সমুদ্রের তেল, গ্যাস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে। এজন্য সব ধরনের বাধা দূর করতে হবে। সবসময় আউট অব বক্স অর্থাৎ গণ্ডির বাইরে চিন্তাকে প্রসারিত করতে হবে। বর্তমানে যেকোনো একটি বিষয়ে অনুমোদন নিতে হলে সরকারের অনেকগুলো মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দ্বারস্থ হতে হয়। সেই অবস্থা পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
জুয়েনা আজিজ বলেন, টেকইস উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে দেশের অর্থনীতিকেও টেকসই করতে হবে। সেক্ষেত্রে উন্নত দেশে যেতে হলে নিজস্ব সম্পদের ব্যবহার বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সমুদ্র অর্থনীতির যে বিপুল সম্ভাবনা আছে সেটি কাজে লাগাতে চায় সরকার। এজন্য সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
ড. কাউসার আহাম্মদ বলেন, উন্নত দেশে যেতে হলে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পরিবেশকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। সমুদ্র গবেষণা ও সম্পদ কাজে লাগানোর বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এ নিয়ে নানা উদ্যোগ থাকলেও সেটি আরও জোরদার করা প্রয়োজন। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সাগরের মাছসহ নানা সম্পদের বিষয়ে আমরা অনেক কিছুই জানি। কিন্তু এখন প্রয়োজন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।