বিবর্তন, শৃঙ্খল ও বিশৃঙ্খলা

পুঁজিপতিরা সমাজ পরিবর্তনের নাম করে নানা সময়ে বিভিন্ন নামকরণের ছলে নিজেদের উলঙ্গ দশাকে মানুষের সামনে নিয়ে এসেছে। কারণ শ্রেণিসংঘাত ও নানা ধরনের বিপ্লবের বিপরীতে তাদের টিকে থাকা প্রায় কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছিল বারবার। বাস্তব চিত্রে দেখা যায়, প্রাচীন সমাজ ও সভ্যতাকে সজোরে উৎখাত করে মধ্যবর্তী অবস্থা সৃষ্টি করা হয়। এসময় নানা রকমের রাজা-বাদশার মাধ্যমে সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থার জন্ম নেয়। বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শিকার ও কৃষিনির্ভর সমাজ কালের পরিক্রমায় করায়ত্ত হয় সামন্তবাদী রাজাদের হাতে। এককথায় মালিকশ্রেণি ও দাসশ্রেণি সূচনা বা সৃষ্টি করা হয়। নানা ধরনের প্রথার বিস্তার এ সময় থেকেই দেখা যায়।

এরপর একটা সময় দাসত্বের হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রমিক, কৃষক ও দিনমজুদের তোড়জোড় ও নানামুখী আন্দোলনের মুখে পুঁজিপতিরা নতুন মোড়কে নিজেদের আবির্ভাব ঘটায় এবং সমাজতন্ত্রের ধারণা সৃষ্টি হয়।

এরই মধ্য দিয়ে আবারও তারা সুকৌশলে নতুন মধ্যবর্তী শ্রেণি সৃষ্টি করে, যারা প্রকৃতপক্ষে পুঁজিপতিদেরই প্রতিনিধিত্ব করতে থাকে। সামন্তবাদের শেষ দিকে কলকারখানায় স্টিম শিল্পবিপ্লবের নামে নতুন সমাজ সৃষ্টির আকাক্সক্ষা শ্রেণিসংগ্রামকে আরও ত্বরান্বিত করে, যা পরবর্তীকালে যন্ত্রবিপ্লব এবং এরই ধারাবাহিকতায় প্রায় দুই দশকের ব্যবধানে দুটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ তথা বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়। এরপর পুঁজিবাদীরা নতুন এক সাম্রাজ্যবাদের দিকে হাঁটতে থাকে। এর আগে প্রাচীন সমাজ থেকে মধ্যবর্তী বা সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থায় অবশ্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার টানাপড়েন স্পষ্ট হতে থাকে এবং যথাক্রমে উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যথাক্রমে বিনিময় প্রথা ও মুদ্রানীতির প্রবর্তন ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পাউন্ড থেকে ডলারের প্রচলন শুরু হয়। পরবর্তীকালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টির মাধ্যমে পাউন্ডকে সরিয়ে দিয়ে নিজের অবস্থান শক্ত করে ডলার। এরই মাধ্যমে উত্তরাধুনিক সমাজব্যবস্থা পবর্তিত হয়, যা এখনও চলমান।

কম্পিউটার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজে আকস্মিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এসময় সমাজতন্ত্রকে অপসারণ করে গণতন্ত্রের সূচনা হয়। বর্তমান বহমান এই ধারায় প্রযুক্তির বিপ্লব দেখা যাচ্ছে।

বর্তমানে পুঁজিবাদীরা একদিকে গণতন্ত্রের বুলি আওরাচ্ছে, অন্যদিকে যন্ত্র ও অস্ত্রনির্মাতাদের অস্ত্র ব্যবসাকে উসকে দিচ্ছে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার নামে আগ্রাসনমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অজুহাত দেখানোর মাধ্যমে। একইসঙ্গে খুবই রোমাঞ্চকর হলেও সত্য যে, এখন আর পুঁজিবাদীদের উপনিবেশ সৃষ্টি বা ভূমি দখলের মতো পথে হাঁটতে হয় না। তারা সুকৌশলে মননে বিষ প্রয়োগ করতে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে। তারা ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা দখলের পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক সত্তার দখল নিতে বেশ শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। এর ফলে সমাজে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় ও যুদ্ধ-শান্তির ভেদাভেদ নির্ধারণ করা বেশ দুরূহ হয়ে গেছে। একইসঙ্গে শত্রু-মিত্র চিনে ওঠাটাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলের ধর্মযুদ্ধ, বর্ণবাদ ও ভিন্নমতকে দমনের নামে আগ্রাসনমূলক কর্মকাণ্ড চলছে। এক্ষেত্রে তারা প্রচারমাধ্যমগুলোকে সজোরে কামড়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে, যাতে তারা সঠিক তথ্য প্রকাশ করতে না পারে। আজ রোবট ও মহাকাশ অভিযানে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেয়া হয়, কিন্তু অসহায় মানুষের জোটে না এক মুঠো ডাল-ভাত। আগের মতো প্রথা নেই, রয়েছে আইন; নেই শৃঙ্খলা, রয়েছে শুধু বিশৃঙ্খলা।

আকিক তানজিল জিহান

শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০