আ. ন. ম. মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: বিশ্বজগতের প্রাণিকুলের বেঁচে থাকার দুটি অপরিহার্য উপাদান হলো শ্বাস-প্রশ্বাস আর ভাষা। প্রাণীভেদে ভাষারও ভিন্নতা বিদ্যমান। সৃষ্টিকর্তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি যেমন মানুষ, তেমনি মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হলো তার ভাষা। ভাষাবিহীন মানুষ মৃতপ্রায়। সমাজ, জাত, ধর্ম-বর্ণ, দেশভেদে ভাষার ভিন্নতা থাকলেও প্রত্যেক মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, হতাশার অভিব্যক্তি একই রকমের হয়ে থাকে। এখানে নেই কোনো ভিন্নতা।
বিশ্বের ৭০০ কোটিরও অধিক মানুষ হাজারো ভাষার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তাদের ভাবের আদান-প্রদান করে চলেছে। ন্যাশনাল এনসাইক্লোপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে ৭ হাজার ৩৭৮টি ভাষা এবং প্রায় ৩৯ হাজার ৪০০ উপভাষা রয়েছে। সারা বিশ্বের ২৫ কোটি মানুষের ব্যবহƒত ভাষা হিসেবে বাংলা’র অবস্থান সপ্তম স্থানে। জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের মানবাধিকার-সংক্রান্ত ঘোষণা পত্রটিও মোট ৩২২টি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।
মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য পৃথিবীতে জীবন উৎসর্গের অসংখ্য নজির থাকলেও মাতৃভাষা রক্ষার জন্য রক্তক্ষয়ী ইতিহাস একমাত্র বাংলা ভাষারই রয়েছে। রফিক, সালাম, বরকত ও জব্বারের মতো বেশ কয়েকজন শহিদের রক্তের বিনিময়ে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষা সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯৮ সালে কানাডা প্রবাসী রফিক ও সালাম নামের দুই বাংলাদেশির অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের এক অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা অনন্য মর্যাদায় আসীন হয়।
স্রোতের অভাবে অসংখ্য নদী যেমন বিলীন হয়ে যায়, তেমনি দিনের পর দিন অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে কালের অতল গহ্বরে। আবার অসংখ্য ভাষা তার স্বকীয়তা দিয়ে মানুষের মুখে মুখে টিকে থাকে যুগ-যুগান্তরে। বর্তমানে মিশ্র সংস্কৃতি তথা বিশ্বায়নের আগ্রাসনে বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষা অস্তিত্বের সংকটে পতিত হয়েছে।
অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। ইংল্যান্ডের সর্বস্তরের ভাষা ইংরেজি। আদালতের ভাষাও ইংরেজি। আদালত অঙ্গনের এমন কিছু বিষয় আছে, যেখানে লাতিন শব্দ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু জনগণ এই লাতিন শব্দগুলোর অর্থ অনুধাবন করতে পারে না, সে কথা চিন্তা করে লর্ড ইলফ তার অ্যাকসেস টু জাস্টিসে সুপারিশ করেন যে, আদালতের ভাষা থেকে অবোধ্য ও স্বল্প ব্যবহƒত লাতিন শব্দ বাদ দেয়া হোক। নেপাল বিশ্বের উন্নত দেশের মধ্যে পড়ে না, প্রায় আমাদের সমগোত্রীয় দেশ। সেখানে ১২ জুন ১৯৯৫ সাল থেকে সর্বোচ্চ আদালতসহ সর্ব রাষ্ট্রকর্মে জনগণের ভাষা নেপালিতে সম্পন্ন হয়।
মালয়েশিয়ার ফেডারেল সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ এবং ১৯৬৩ সালের জাতীয় ভাষা আইনের ৮ ধারা অনুসারে, আদালতের রায় বাহাস মালয়েশিয়ার লেখার বাধ্যবাধকতা থাকায় আদালতের পূর্বানুমতি নিয়েও যদি কোনো মামলার আরজি বাহাস অন্য কোনো ভাষায় লেখা হয়, তা অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দেয়া হয়!
দক্ষিণ আফ্রিকায় ১১টি ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে। তার মধ্যে মাত্র দুটি ভাষা আদালতে ব্যবহƒত হয়। রায় প্রকাশিত হওয়ার পর বা মামলার শুনানিকালে মামলার বিষয়বস্তু ও রায় অন্য ভাষাগুলোতে দোভাষীরা অনুবাদ করে দেন। তুরস্কের আদালতের ভাষা এখন কুর্দি ও তুর্কি।
কানাডা সুপ্রিম কোর্টেও প্রতিটি রায় ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অফিশিয়াল রিপোর্টে ছাপানো বাধ্যতামূলক। কানাডার সুপ্রিম কোর্ট একটি মামলায় রায় প্রধান করেন, ভাষা বেছে নেয়ার অধিকার অভিযুক্তের ‘সাবস্টেনটিভ রাইট’। প্রসিডিউরাল নয়। অন্য এক মামলায় কানাডিয়ান সুপ্রিম কোর্ট বলেন, ভাষার অধিকার সব মামলার ক্ষেত্রে অবশ্যই নিষ্ঠার সঙ্গে দেখতে হবে। ভাষার অধিকার নেতিবাচক কিংবা পরোক্ষ অধিকার নয়।
সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক, জাপান, ফ্রাস, জার্মানি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, চীন, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের উচ্চ আদালতের ভাষা তাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা বা মাতৃভাষা, ইংরেজি নয়। তবে যেসব দেশে মাতৃভাষায় তাদের রায় প্রদান করেন, তারা প্রত্যেকেই অনুবাদকের দ্বারা সেই রায়টি অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করিয়ে দেন।
বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৮৩৭ সালে বাংলার আদালতগুলোয় দেশীয় ভাষায় বিচারকার্য শুরু হয়, যদিও মামলার রায় দেয়া হতো ইংরেজিতে। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ধারা ২৪ ও ৩২ উভয় ধারাতে উল্লেখ করা হয়েছে, যে ব্যক্তি জবানবন্দি প্রদান করবে তার ভাষাতে তা লিপিবদ্ধ করতে হবে। অন্য কোনো ভাষায় কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। ১৯৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫৭ (১) ধারার ভাষ্যমতে, প্রত্যেকটি সাক্ষীর সাক্ষ্য দায়রা জজ বা হাকিম কর্তৃক তাহার নিজ হাতে ও তাহার মাতৃভাষায় লিখিত হইবে। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে বেশ কিছু জনগুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় হয়েছে। এসব মামলার রায়ে কী বলা হয়েছে। জনগণ হিসেবে তা জানার অধিকার সবারই আছে। বিজ্ঞ আদালত ইংরেজি ভাষায় রায় প্রদান করার কারণে দেশের বেশিরভাগ মানুষই মামলাগুলোর রায় বিষয়ে কী বলা হয়েছে, তা কিছুই জানেন না। যদিও সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ধারা-৭৪ মতে, মামলার রায় হচ্ছে সরকারি দলিল (পাবলিক ডকুমেন্ট)। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বর্তমানে কোনো বিচারকের মাতৃভাষা ইংরেজি নয়, তারপরও কেন রায়গুলো ইংরেজি ভাষায় দেয়া হয়।
নদীর স্রোতের মতো চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভাষা ধাবিত হয় আগামীর পথে। স্রোতের অভাবে অসংখ্য নদী যেমন বিলীন হয়ে যায়। তেমনি চর্চার অভাবে দিনের পর দিন অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে কালের অতল গহ্বরে। ইতোমধ্যে বাংলার বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা হারিয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে কালক্রমে বাংলার মতো অন্যতম প্রাচীন ভাষাও হারিয়ে ফেলতে পারে তার স্বকীয়তা।
তাই কবিতার ভাষায় বলতে চাই,
যুগে যুগে জনে জনে
বাংলা থাকুক সবার প্রাণে
বাংলা ছুটুক গল্প গানে,
বাংলা বাঁচুক সবার মনে
আমাদের দেশে শুধু ফেব্রুয়ারি এলেই বিভিন্ন ব্যক্তির মুখে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভাষা প্রেম দেখা যায়। বাংলা ভাষার পেছনে বাঙালি জাতির যে আত্মত্যাগ তার মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকুক। এর একটি পদক্ষেপ হিসেবে বিচারকার্যের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় কাজের সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন করা হোক। শুধু ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বাংলার সর্বোত্তম ব্যবহার ও চর্চা হোক ঘরে ঘরে, জনে জনে।
আইনজীবী
masumbillahlaw06@gmail.com