Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 1:13 am

বিমা খাতে সঠিক পরিকল্পনা কর্মসংস্থানের অপার সম্ভাবনা

মো. নূরউলআলম: বিমা হলো ঝুঁকি বহনের চুক্তি। এজন্য বিমা পলিসিকে বিমা চুক্তি বা ক্ষতিপূরণের চুক্তিও বলা চলে। এটি দু’পক্ষের মধ্যে একটি আইনসম্মত চুক্তি। একপক্ষ অন্যপক্ষকে ক্ষতিপূরণ দেবে বলে নিশ্চয়তা দিয়ে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। অন্যপক্ষ, যার বিমাযোগ্য স্বার্থ আছে, তিনি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট হারে প্রিমিয়াম প্রদানের নিশ্চয়তা দিয়ে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এভাবে বিমা হলো প্রথম পক্ষ বিমাকারী বা বিমা কোম্পানি এবং দ্বিতীয় পক্ষ বিমাগ্রহীতার মধ্যে যথাক্রমে ক্ষতিপূরণ প্রদান ও প্রিমিয়াম প্রদানের নিশ্চয়তা-সংবলিত একটি চুক্তি।

বিমা চুক্তি ও বিমা প্রিমিয়াম নির্ভর করে ‘বিমাযোগ্য বিষয়’-এর বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ওপর। তথ্য-উপাত্ত বা ডেটা বিশ্লেষণের কাজ করতে প্রয়োজন ওই বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ। তাই বিভিন্ন বিমা পলিসি বিক্রয়, বিক্রয় ব্যবস্থাপনা ও কোম্পানি ব্যবস্থাপনায় দরকার দক্ষ মানবসম্পদ। অধিকন্তু বিমা পলিসি বিপণন শৃঙ্খলে কিংবা বিমা দাবি প্রদান প্রক্রিয়ায় অথবা অপরাপর সব বিষয়ে সার্বিক ব্যবস্থাপনার প্রত্যেক স্তরে প্রয়োজন প্রশিক্ষিত জনশক্তি। অথচ দেশের এ গুরুত্বপূর্ণ খাতটি চলছে অদক্ষ ও অপর্যাপ্ত জনশক্তি দিয়ে।

আমাদের দেশে তৈরি পোশাক খাতের পরই বিমা খাত হলো দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান খাত। কিন্তু প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান অনেক অপ্রতুল। ব্যাংক, বিমা ও পুঁজিবাজারÑআর্থিক খাতের এ তিনটির মধ্যে বিমাই সবচেয়ে পিছিয়ে। শুধু পিছিয়ে আছে বললে কমই বলা হবে, বরং বলা উচিত অর্থনীতির আকারের তুলনায় অনেক পিছিয়ে এ খাত। ২০১৯ সালে জিডিপিতে এ খাতের অবদান ছিল মাত্র দশমিক ৪৯ শতাংশ। ২০২০ সালে তা আরও কমে দশমিক ৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে সুইস রি ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত সিগমা রিপোর্ট। বিমা প্রিমিয়ামে বাংলাদেশের মাথাপিছু ব্যয় ৯ মার্কিন ডলার, যা সারা বিশ্বেই নি¤œতম। যথাযথ নীতি প্রণয়নের অভাবে খাতটি থেকে ভালো কিছু বের করে আনতে পারছে না বাংলাদেশ।

শুধু প্রবাসী আয় এবং তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয় দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে তার ঈপ্সিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব নয়, কেননা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যা। অথচ বিনিয়োগের বিকল্প খাত তৈরি না হওয়ার ফলে বিনিয়োগ বাড়ছে না, বাড়ছে না কর্মসংস্থানও। ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে যোগ হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান প্রায় শত ভাগ পাসের হার। ফলে বাড়ছে পুঞ্জীভূত ব্যাপক বেকারত্ব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার প্রায় ছিল চার দশমিক ছয় শতাংশ। সংখ্যার হিসেবে তা প্রায় এক কোটি ৩৮ লাখ! মনে রাখতে হবে, এ পরিসংখ্যানে ছদ্ম বেকারত্বকে বিচেনায় নেয়া হয়নি। তা বিবেচনায় নিলে হারটি আরও বাড়বে।

কভিড মহামারির কারণে দেশে বিভিন্ন খাতে কর্মহীন হয়েছে অসংখ্য কর্মক্ষম মানুষ। দেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ কর্মবাজারে প্রবেশ করে। এর মধ্যে ছয়-সাত লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয় বিদেশে। তবে কভিড মহামারির কারণে দেশে বেকারত্বের হার আরও বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে স্বাভাবিক বেকারত্বের হার চার দশমিক দুই শতাংশ হলেও যুব বেকারত্বের হার ১১ দশমিক ছয় শতাংশ। কভিডের কারণে সেটি কয়েকগুণ বেড়ে গেছে বলে বিভিন্ন পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, কভিড মহামারিতে বিশ্বে ছয়জনের মধ্যে একজন বেকার হয়েছে, আর বাংলাদেশে বেকার হয়েছে চারজন যুবকের মধ্যে একজন, যা প্রায় ২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। কভিডে কর্মহীন জনগোষ্ঠী নিয়ে গবেষণা করেছেন অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত। তার গবেষণায় দেখানো হয়, দেশে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে ছয় কোটি ৮২ লাখ আট হাজার মানুষ কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। শুধু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়েছেন তিন কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন। অর্থাৎ মোট কর্মগোষ্ঠীর ৫৯ শতাংশ মানুষই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকার হয়েছে সেবা খাতে। বিমা খাত সেবা খাতেরই একটা অংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বর্তমানে নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক ড. বিরূপাক্ষ পাল ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে উচ্চ জিডিপি সত্ত্বেও বাংলাদেশে বেকারত্ব কেন বাড়ছেÑএমন প্রশ্নের জবাবে আয়ের অনানুষ্ঠানিক খাতের বিশালত্বকে এজন্য দায়ী করেন। অনানুষ্ঠানিক আয় হলো মূলত সেসব আয়, যা আয়কারী আয় হিসেবে কোথাও প্রকাশ করেন না। ফলে প্রাথমিকভাবে তা জিডিপি গণনায় বাদ পড়ে যায়। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ডেটার মান নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ব্যবহƒত তথ্য-উপাত্তকে পৃথিবীতে সবচেয়ে মানহীন বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক দেশই তথ্য-উপাত্তর সত্যতা এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে পাঁচ স্তরবিশিষ্ট ফিল্টারিং করে, যা বাংলাদেশ অনুসরণ করে না। তাই শুনতে অস্বস্তি লাগলেও বলতে হয় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রদত্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্বে সবচেয়ে মানহীন। আরও অনেক গবেষকও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য-উপাত্তর মান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, বেকারত্বের প্রকৃত সংখ্যাটি সন্দেহাতীতভাবে আরও অনেক বড় হবে।

আরেক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ এখন কর্মক্ষম জনসংখ্যার দিক দিয়ে স্বর্ণযুগে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ৬৮ শতাংশ জনসংখ্যা কর্মক্ষম, যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনবৈজ্ঞানিক মুনাফা হিসেবে পরিচিত। কোনো দেশে যদি ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ কর্মক্ষম থাকে, তাহলে সেদেশকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনবৈজ্ঞানিক মুনাফা অবস্থায় আছে বলে গণ্য করা হয়।

জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ কর্মক্ষম থাকার এ ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে তো বটেই পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল। সঠিকভাবে কাজে না লাগালে এ সুবিধাজনক অবস্থা অচিরেই পরনির্ভরশীল জনসংখ্যার পরিমাণ বাড়িয়ে দেশের দায় হিসেবে আবির্ভূত হবে। দ্রুত ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করতে পারলে ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের কারণে অচিরেই বাংলাদেশের সব অর্জন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তাই জাতীয় অর্থনীতির অন্যান্য চলক বা অনুঘটকগুলোর এক বা একাধিক অনুঘটককে ধাক্কা দেয়া এখন অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।

কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে কভিড-উত্তর সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। বিমা খাত হতে পারে কর্মসংস্থানের অপার সম্ভাবনাময় একটি খাত, যা হতে পারে অর্থনৈতিক ঝুঁকি রোধের অন্যতম প্রধান মোক্ষম হাতিয়ারও। ২০২২ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে পৃথিবীতে ৩০তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। অথচ আমাদের দেশের বিমা খাত বিশ্বে ৭৬তম বৃহত্তম এবং বিমা খাতে বাংলাদেশ তলানির দেশ হিসেবে গণ্য। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ‘বিমা ফাঁক’ প্রায় সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা মোট জিডিপির দুই দশমিক এক শতাংশ। এটি দেশের অর্থনীতিতে বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। উপরন্তু অর্থনীতির আকার আরও বড় হলে ওই ‘বিমা ফাঁক’ আরও বেড়ে যাবে।

প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার্স কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাত্র এক শতাংশ বিমা অবদান বৃদ্ধি এবং দুই শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি করে। এর কারণ এটি ২২ শতাংশ অবিমাজনিত ক্ষতি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগোত্তর কর অবদান হ্রাস ১৩ শতাংশ পর্যন্ত ঠেকিয়ে দিতে সহায়তা করে। বিমা অবদানের গাণিতিক বৃদ্ধি জ্যামিতিকভাবে জিডিপির বৃদ্ধি ঘটাবে। বিমা শিল্প কেবল ব্যবসায় বাণিজ্যের স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরিতেই অবদান রাখে না, বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অর্থনৈতিক সংকটের সময় সরকারের আর্থিক চাপ হ্রাস করতেও সহায়তা করে।

লন্ডনভিত্তিক বিশ্বের অন্যতম সেরা বিমা মার্কেট লয়েডের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ সাধারণ বিমা খাতে সবচেয়ে কম বিমাকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। লয়েডের মতে, বাংলাদেশের এমন অবস্থার কারণ প্রতিবছর দেশটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তার জিডিপির দশমিক আট শতাংশ হারায়। লয়েড আরও বলেছে যে, বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হবে বাংলাদেশ। অথচ এ বিষয়ে দেশটির কেন প্রস্তুতি চোখে পড়ছে না এবং ফান্ড রিকোভারি বা তহবিল পুনরুদ্ধার সামর্থ্যরে দিক থেকেও বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে। অতএব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অবিমাজনিত ক্ষতি হ্রাস করতে বাংলাদেশের বিমা খাতের সংস্কার করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।

উচ্চ কমিশনের বিনিময়ে প্রিমিয়াম সংগ্রহ, কম পুনর্বিমা, দেরিতে দাবি নিষ্পত্তি, অন্যায্য প্রভাব, খুবই দুর্বল জনশক্তির মান, পরিচালন দুর্বলতা, ব্যাংকারদের কমিশন বাণিজ্য, সার্ভেয়ারদের মনগড়া সার্ভে এবং বিভিন্ন অনিয়মের কারণে এ খাত অগ্রসর হতে পারছে না। মূলত বর্ণিত বিষয়ে প্রয়োজনীয় সরকারি নজরদারি এবং বিমা খাতের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ৩৩টি জীবন বিমা কোম্পানি ও ৪৬টি সাধারণ বিমা কোম্পানি যথাক্রমে অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যা এবং ৩০তম বৃহত্তম অর্থনীতির কোনো সুবিধাই নিতে পারছে না।

পরিশেষে বলা চলে, কভিড-পরবর্তী ব্যাপক বেকারত্বের লাগাম টেনে ধরতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অবিমাজনিত ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে এবং টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশের বিমা খাতে ব্যাপক সংস্কার করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশের অর্থনীতির তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রবাহ হিসেবে বিমা খাত ব্যাপকভাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে প্রয়োজনীয় গতি পাবে না। এ খাতের জন্য তাই প্রয়োজন সুষ্ঠ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন। তবেই অর্থনীতিতে গতিশীল তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রবাহ হিসেবে ব্যাপক অবদান রাখতে পারবে বিমা খাত।

সহযোগী সদস্য, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি)

csnoor.bd@gmail.com