উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধন হয় ১৯৯৮ সালে। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে হাত দেওয়ার আগপর্যন্ত এটি বাংলাদেশের অন্যতম আলোচিত অবকাঠামো ছিল বললে ভুল হবে না। সেতু সংলগ্ন এলাকাটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে এখনও। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, সেতুর নিরাপত্তার ব্যাপারে শুরুতে নানা ধরনের কথা শোনা গেলেও পরবর্তী সময়ে তা নিয়ে কিছু সংশয় সৃষ্টি হয় জনমনে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সেতুটি উদ্বোধন হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে এতে ফাটল দেখা দিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। তবে গতকালের শেয়ার বিজে ছাপা ‘ত্রুটিপূর্ণ নকশার জন্য বঙ্গবন্ধু সেতুতে ফাটল!’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে উদ্বোধনের পর নয় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই দেখা দিয়েছিল ফাটল। সেতুটির নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হুন্দাই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ১৯৯৭ সাল এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আরপিটি-নাডিকো-বিসিএলের ১৯৯৯ সালের প্রতিবেদনেই ফাটলের কথা উল্লেখ রয়েছে বলে জানাচ্ছেন আমাদের প্রতিবেদক। তদুপরি ২০০৬ সালে সেতুটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা মার্গা নেট ওয়ান লিমিটেডের প্রতিবেদনেও মিলছে একই তথ্য। প্রশ্ন হলো, নির্মাণকালেই সেতুতে ফাটল সৃষ্টি হলো কীভাবে? বলার অপেক্ষা রাখে না, সেজন্য প্রধানত দায়ী সেতুর নকশা। বঙ্গবন্ধু সেতুর নকশা প্রণয়নে অনুসরণ করা হয় ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড (বিএস) ৫৪০০। ১৯৭৮ সালে প্রণীত এ ম্যানুয়াল অনুযায়ী, বাতাসে তাপমাত্রা ২৪-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলে সেতুর উপরিকাঠামোর (সুপারস্ট্রাকচার) তাপমাত্রা ২৭ থেকে ৩৭ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠানামা করবে। এদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) পরিচালিত একাধিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, গ্রীষ্মকালে সেতুটির সুপারস্ট্রাকচারের তাপমাত্রা ১৯ থেকে ৪৫ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠানামা করে। শীত মৌসুমে এ তাপমাত্রা থাকে ১৩ থেকে ৩২ ডিগ্রির মধ্যে। তবে গ্রীষ্মে হঠাৎ শিলাবৃষ্টি হলে ঘণ্টার ব্যবধানেই তাপমাত্রা কমে যায় ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর তাপমাত্রার এ ধরনের পার্থক্য আমলে না নেওয়ায়ই সেতুতে ফাটল সৃষ্টির মতো বিপত্তি।
খেয়াল করার মতো বিষয়, অতীত দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে এবার কিন্তু ইস্যুটিকে এড়িয়ে চলছে না কর্তৃপক্ষ। সে সময় এ-বিষয়ক স্থানীয় দক্ষ জনবলের অভাব ছিল, এ কথাও অনস্বীকার্য। লক্ষণীয়, এখন ফাটল সৃষ্টির পর তা মেরামতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কথাও শোনা যাচ্ছে। তবে ফাটল নিবারক আঠা ব্যবহারের চেয়ে ফাটল যাতে সৃষ্টি না হয় সেটাই ছিল কাম্য। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রথম কথা হলো, ফাটল নিবারণেও যেন ভুল পদ্ধতি বেছে নেওয়া না হয়। ফলে ওই বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে রক্ষণাবেক্ষণকারীদের। দ্বিতীয়ত, যাদের কারণে সেতুর নকশার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে ত্রুটি, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হোক। অতীতে আমরা দেখেছি, এ ধরনের বড় ভুলের বেলায় জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের কথা উঠলেই কাদা ছোড়াছুড়ি চলে অর্থাৎ একের দায় অন্যের ওপর চাপানোর চেষ্টা চলে। অন্তত বৃহৎ ও স্পর্শকাতর অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে এসব প্রশ্নে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। এর নকশায় যেন কোনো ত্রুটি না থাকে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও নিকট ভবিষ্যতে আলোর মুখ দেখবে বলে আশা করা যায়। সেখানে বঙ্গবন্ধু সেতুর মতো সামান্য ত্রুটিই কিন্তু মারাত্মক কুপ্রভাব বয়ে আনতে পারে। ফলে বিলম্বিত বোধোদয়ের আগেই ত্রুটির নিবারণ হোক, এটাই প্রত্যাশা।