Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 6:08 pm

বিলাতে বাঙালিদের আরেকটি যুদ্ধজয়ের গল্প

শামীম আহমেদ: ১৯৭৮ সালের ৪ মে লন্ডনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দিন তিন কিশোর মিলে বস্ত্র শ্রমিক আলতাব আলীকে হত্যা করে। ওই কিশোররা আলতাব আলীকে চিনত না। মূলত ভিন্ন বর্ণের মানুষকে মারাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। তার মৃত্যুর পর বিলাতে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা নতুন করে উপলব্ধি করল, বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম ছাড়া কোনো পথ নেই।

আজ ব্রিটেনে বাঙালি অধিবাসী ব্যবসা-বাণিজ্য, পড়াশোনা, রাজনীতি ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়ে দেশের নাম উজ্জ্বল করছেন সত্তর দশকে এসব কল্পনাও করা যেত না। তৎকালীন সময় বাঙালিদের জন্য পথে পথে ছিল বিপদ, অন্ধকার আর মৃত্যুর হাতছানি।

জানা যায়, ব্রিটেনের বাঙালিদের আগমন ঘটে আজ থেকে আড়াইশ বছর আগে। কারও কারও মতে তারও আগে। ইতিহাসবিদদের অনেকেই মনে করেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে যাওয়ার পর থেকেই বাঙালিসহ ভারতীদের ব্রিটেনে আগমন শুরু হয়। তবে ১৯৩০ সালের শুরুর দিকে সিলেট অঞ্চলের মানুষ ব্রিটিশ জাহাজ কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে ব্যাপকহারে ব্রিটেনে আসা শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রমিক স্বল্পতার কারণে ব্রিটিশ সরকারের পূর্বের উপনিবেশগুলো থেকে বিপুলসংখ্যক অভিবাসন প্রত্যাশীকে সেই দেশে স্বাগত জানায়। সেই সময় বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল থেকে যুক্তরাজ্যে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ হলেও ধীরে ধীরে শিক্ষা এবং চাকরির সন্ধানে অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষ যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। এভাবে একসময় যুক্তরাজ্যে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষদের একটি বৃহৎ সমাজ গড়ে ওঠে।

১৯৭৮ সালের শুরুর দিকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিরোধীদলীয় নেতা মারগারেট থ্যাচার ‘ওয়ার্ড ইন অ্যাকশন’ নামক একটি টেলিভিশন প্রোগ্রামে বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশদের একটি অংশ মনে করে ব্রিটেনে আগত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অভিবাসীদের কারণে তাদের কৃষ্টি সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়বে।’ তার এই মন্তব্যটি টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার পর ব্রিটেনের বর্ণবাদী ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও অন্যান্য বর্ণবাদীরা সমগ্র ব্রিটেন, বিশেষ করে ইস্ট লন্ডনের ব্রিকলেন ও তার আশপাশ এলাকায় বাঙালি অভিবাসীদের ওপর ক্রমাগতভাবে শারীরিক আক্রমণ ও বর্ণবাদী আচরণ চালাতে থাকে। এ সময় গোটা ব্রিটেন চাকরি ও আবাসিক সমস্যা ছিল প্রকট। বাঙালি শ্রমিক বিশেষ করে গার্মেট শ্রমিকরা নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছিলেন। তারা বাসস্থান, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি বর্ণবাদের শিকার হয়েছিলেন। এ সময় যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে কয়েকটি উগ্র জাতীয়তাবাদী শ্বেতাঙ্গ সংগঠনের তৎপরতা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এসব সংগঠন অভিবাসী বিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম, যেমনÑঘৃণা ও জাতিবিদ্বেষের চর্চা পরিচালনা করে আসছিল। ফলে যুক্তরাজ্যে অবস্থানকারী বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের ওপর সহিংস বর্ণবাদী হামলা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনই একটি সহিংস বর্ণবাদী হামলায় ১৯৭৮ সালের ৪ মে মাত্র ২৪ বছর বয়সে আলতাব আলী নামে এক বাঙালি অভিবাসী গার্মেট নিহত হন।

আলতাব আলী ১৯৫৩ সালে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার সৈরদরগাঁও ইউনিয়নের মোল্লাআতা গ্রামে জš§গ্রহণ করেন। বাবা হাজি আব্দুস সামাদ ও মা সোনাবান বিবির সাত সন্তানের মধ্যে আলতাব আলী ছিলেন সবার বড়। গোবিন্দগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করা আলতাব মদনমোহন কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা আনার জন্য যুক্তরাজ্যপ্রবাসী চাচা আব্দুল হাসিমের সহায়তায় ১৯৬৯ সালে দেশটিতে পাড়ি জমান। যুক্তরাজ্যে আলতাব একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। ১৯৭৮ সালের ৪ মে যুক্তরাজ্যের বাংলাভাষী অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেন এলাকায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন উপলক্ষে ভোটগ্রহণের দিন ধার্য ছিল। কারখানায় কাজ করে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে আলতাব সেদিন বাসায় ফিরছিলেন। সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটের সময় তিনি লন্ডনের এডলার স্ট্রিটের সেন্ট মেরি পার্কে পৌঁছামাত্রই তিন কিশোর দুর্বৃত্ত তার ওপর ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে তিনি লুটিয়ে পড়েন।

আলতাব আলীর বন্ধু শামসুদ্দিন বলেন, ‘আলতাব আলী যখন মারা গেলেন, তখন আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা রইল না। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের লড়াইয়ে নামতে হলো।’

১৯৭০ দশকের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকর্মী আনসার আহমেদ উল্লাহ বলেন, ‘বাঙালিরা একা একা কোথাও যেতে পারত না; তাদের প্রায়ই হেনস্তার শিকার হতে হতো। সরকারি ফ্ল্যাটবাড়িতে যারা থাকত, তাদের প্রতিবেশীরা তাদের সঙ্গে বেশিরভাগ সময়েই দুর্ব্যবহার করত। তারা জানালার কাচ ভেঙে দিত, লেটারবক্সের মধ্যে দিয়ে আবর্জনা ফেলে দিতÑএককথায় জীবন দুর্বিষহ করে তুলত।’

‘দি ব্যাটল অব ব্রিকলেন’ বইয়ের লেখক ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকর্মী  একে আজাদ কনর বলেন, ‘বাংলাদেশিরা এখানে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছেন। কিন্তু আমি এখনও অনুভব করি বর্ণবাদ দূর করতে হলে এখনও আমাদের কাজ করতে হবে। এখনও পুলিশ, এনএইচএসের (জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা) মতো অসংখ্য সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বর্ণবাদী মনোভাবের শিকার হতে হয়।’

আলতাব আলীর মৃত্যুর পর বর্ণবাদবিরোধী সংগঠন ‘বাংলাদেশি ইয়ুথ ফ্রন্ট’ (ইণঋ) গঠন করা হয়। এ সময় পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেন এলাকায় অভিবাসীদের ওপর ক্রমবর্ধমান জাতিবিদ্বেষ এবং বর্ণবাদী হামলার বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আলতাব আলীর মৃত্যুর প্রায় ৭ হাজার মানুষ তার কফিন মিছিল নিয়ে লন্ডনের হাইড পার্ক, ট্রাফালগার স্কয়ার এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং বিক্ষোভকারীরা পূর্ব লন্ডনের অভিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় অবিলম্বে জাতিবিদ্বেষ এবং বর্ণবাদী আক্রমণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। বর্ণবাদ ও জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যুক্তরাজ্যের সাধারণ মানুষের সমর্থন দেখে উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো আবারও পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেনে চোরাগোপ্তা হামলা শুরু করে। ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদর দপ্তর পূর্ব লন্ডনের সেন্ট মেরি পার্কের কাছে স্থানান্তর করা হলে পুরো শহরজুড়ে তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয়। হ্যাকনি এলাকায় এরকম আরেকটি বর্ণবাদী হামলায় ১৯৭৮ সালের জুন মাসে ইশহাক আলী নামে আরও একজন নিহত হন। অব্যাহত বর্ণবাদী হামলা আন্দোলনের মাঠে অভিবাসীদের আরও ঐক্যবদ্ধ করে। তারা পুরো যুক্তরাজ্যে একতার ডাক দিয়ে সব বর্ণ-শ্রেণি-পেশার মানুষকে সেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত করেন। সেই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বরে এক বিশাল বর্ণবাদবিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লক্ষাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেন। পরে ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং বিশেষত বাঙালি অভিবাসীদের আন্দোলনের ফলে ধীরে ধীরে পূর্ব লন্ডনে বর্ণবাদী হামলা কমে আসে।

১৯৮৯ সালে বর্ণবাদী হামলার শিকার সব মানুষের স্মরণে সেইন্ট মেরি পার্কে একটি তোরণ নির্মাণ করা হয়। পরে ১৯৯৮ সালে পার্কটির নাম পরিবর্তন করে ‘আলতাব আলী পার্ক’ রাখা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এই পার্কের অভ্যন্তরে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আত্মত্যাগী শহিদদের স্মরণে একটি শহিদ মিনার নির্মিত হয়েছে।

 

তথ্য সূত্র:

১. দ্য ব্যাটল অব ব্রিকলেনÑএ কে আজাদ কনর

২. বিবিসি বাংলা

 

গণমাধ্যমকর্মী