Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 3:22 pm

বিলুপ্ত হওয়া থেকে মৎস্য সম্পদ রক্ষা করা জরুরি

নাদের হোসেন ভূঁইয়া: পুষ্টির চাহিদা পূরণে অবদান রেখে চলেছে দেশের মৎস্য সম্পদ। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) এক গবেষণায় ১৫ প্রজাতির দেশি মাছে প্লাস্টিক কণার (মাইক্রোপ্লাস্টিক) সন্ধান পাওয়া গেছে। কৃত্রিম উপায়ে মিঠাপানির জলাধারে চাষ করা এই মাছগুলো হলোÑকালবাউশ, বেলে, ট্যাংরা, কই, বাটা, রুই, তেলাপিয়া, কমন কার্প, পাবদা, পুঁটি, রয়না, শিলং, বাইন, টাটকিনি ও বাছা। এর মধ্যে ট্যাংরা, টাটকিনি, রয়না বা মেনি মাছে প্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি। পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট’ এ-সংক্রান্ত গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া ১৮ প্রজাতির দেশি মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব নিয়ে অনুসন্ধান করে এর মধ্যে ১৫ প্রজাতির মাছের পরিপাকতন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কৃত্রিম উপায়ে মিঠাপানির জলাধারে চাষ করা মাছগুলোর ৭৩ দশমিক ৩০ শতাংশ প্লাস্টিকের কণা পাওয়া গেছে। কালবাউশ, বেলে, ট্যাংরা, কই, বাটা, রুই, তেলাপিয়া, কমন কার্প, পাবদা, পুঁটি, রয়না, শিলং, বাইন, টাটকিনি ও বাছা মাছে হাই ডেনসিটি পলিথিলিন, পলিপ্রপিলিন পলিথিলিন কপোলিমার ও ইথিলিন ভিনাইল এসিটেটের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে। এসব প্লাস্টিক কণা সরাসরি খাদ্যের সঙ্গে মানুষের দেহে প্রবেশ করে না। তবে এগুলো থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত রাসায়নিক মাছের দেহ বা পেশিতে জমা হয়। পরে এসব মাছ খাবার হিসেবে গ্রহণ করলে মানুষের দেহে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

মাইক্রোপ্লাস্টিক হচ্ছে প্লাস্টিকের ছোট কণা, যার দৈর্ঘ্য পাঁচ মিলিমিটারের চেয়ে কম। বর্জ্য প্লাস্টিক ফটো-কেমিক্যাল এবং বায়োলজিক্যালি ভেঙে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি হয়। এর ক্ষতিকর দিক মারাত্মক। বিভিন্ন দেশে মাছের ওপর মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। এর আগে আমাদের দেশে স্বাদু পানির মাছ নিয়ে কোনো পরীক্ষামূলক গবেষণায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ দৈনিক তিন হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করে। এর মাত্র কিছু অংশ নদী দিয়ে সাগরে যায়। বাকি বর্জ্য এবং গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দেশ থেকে আসা বিপুল প্লাস্টিক বর্জ্যরে একটি অংশ দেশের বিভিন্ন নদ-নদী এবং ভূভাগকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইউএনইপি প্রকাশিত ‘বিশ্বের প্লাস্টিকের ব্যবহার পরিস্থিতি’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,  প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। পরিমাণের দিক থেকে এটি বিশ্বে পঞ্চম। এই বর্জ্যরে উৎস গঙ্গা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দেশ চীন, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা হয়ে এগুলো সাগরে যায়।

বিশ্বে প্রতিদিন তিন কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর ৮০ লাখ টন প্রধান ১০টি নদী অববাহিকা দিয়ে সাগরে গিয়ে পড়ছে। এই ১০ নদীর আটটিরই উৎসস্থল চীন। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দূষণের প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও আছে।

বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডিও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জলে-স্থলে বর্তমানে ৬৫ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়েছে। প্রতিদিন এর সঙ্গে তিন হাজার টন করে যোগ হচ্ছে। সংস্থাটি দেশের পরিবেশের জন্য অন্যতম প্রধান হুমকি হিসেবে প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগকে চিহ্নিত করেছে। তারা বলছে, দেশে যেখানে জৈব বর্জ্য বৃদ্ধির হার পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ। সেখানে প্লাস্টিক বর্জ্যরে বৃদ্ধির হার সাড়ে সাত শতাংশ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক জেনেও দেশের ৬১ শতাংশ মানুষ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছে।

আমাদের দেশে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১০ সালে পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটের ব্যাগ ব্যবহারে আইন হয়। কাগজে-কলমে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে পলিথিন ব্যাগ তৈরির শতাধিক কারখানা রয়েছে। রাজধানীর লালবাগ, হাজারীবাগ, সদরঘাট, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে এসব কারখানা বহাল তবিয়তে নিষিদ্ধ পণ্য উৎপাদন করে যাচ্ছে। বাজারেও এর ব্যবহার প্রায় স্বাভাবিক। এভাবে চলতে থাকলে বিশুদ্ধ মাছের অভাবে হারতে বসবে আমাদের বাঙালি সত্তা।

বিশেষজ্ঞদের প্লাস্টিক পণ্যের বিকল্প হিসেবে পাটজাত দ্রব্য ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ পাট দ্রুত পচনশীল। তাই পাটশিল্পে আমাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে এবং সাধারণ মানুষকে পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহারে উৎসাহী করতে হবে। প্যাকেট ও প্লাস্টিক বোতল জাতীয় খাদ্য দ্রব্যের ক্ষেত্রে পাট ব্যবহার করা না গেলেও পুনরায় প্যাকেটগুলো সংগ্রহ করে, তা পরিশোধন করে ব্যবহারের উপযোগী করা অর্থাৎ রিসাইক্লিং করা যেতে পারে। তাতে প্লাস্টিকের চাহিদা কমে আসবে এবং প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন কমানো সম্ভব। যেমনটা বর্তমান জাপান করছে। শিল্প কারখানা থেকে শুরু করে গৃহস্থালি প্রতিটি ক্ষেত্রে রিসাইকেলের ব্যাপারে তারা বেশ  সচেতন। তাই জাপান বিশ্বে প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের শীর্ষে অবস্থান করছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রর পর জাপানেই সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক ব্যবহার হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অংশ হয়ে দগাঁড়িছে। কিন্তু এর ভয়াবহ প্রভাব চিরতরে বিনষ্টি করে দিচ্ছে আমাদের পরিবেশ, মৎস্য সম্পদ। আমাদের উচিত বাস্তবানুগ পদক্ষেপ নিয়ে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে আনা নিয়ন্ত্রণ করার।

শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ

ফেনী সরকারি কলেজ