মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ: ২৫ জুন পর্তুগাল-ইরান ম্যাচ। পর্তুগাল জিতলে পকেটে আসবে এক লাখ টাকা। এমন আশায় রাজধানীর একটি অভিজাত ক্লাবে জমে উঠে বাজির আসর। তবে হারলে দিতে হবে ৫০ হাজার টাকা। তবে খেলা ড্র হওয়ায় দিতে হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। জানালেন ধানমন্ডির বাসিন্দা আরিফুল হক (ছদ্ম নাম)। একই ধরনের চিত্র ছিল আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া ম্যাচেও। তবে ব্রাজিল-সার্বিয়া ম্যাচে বাজির দর ছিল ব্রাজিলের জয়ে দুই লাখ ও ড্রতে এক লাখ।
গত সোমবারের ঘটনা। পরের দিন মঙ্গলবার রাতে ফুটবলের বিশ্ব আসরে বাঁচা-মরার লড়াইয়ে রাশিয়ার মাঠে নামবে আর্জেন্টিনা ফুটবল দল। প্রতিপক্ষ নাইজেরিয়ার আগের ম্যাচে দুর্দান্ত খেলা দেখে অনেকেই শঙ্কায় ছিলেন মেসিদের বিজয় নিয়ে। সেদিন সকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি সেলুনে চুল কাটাতে যান এ প্রতিবেদক। সেখানে মুখোমুখি হন এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার।
সে সেলুনে কয়েকজন উঠতি বয়সের ছেলে ছিল। তারা কথা বলছিল আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়ার ম্যাচ নিয়ে। কিছুক্ষণ পর বুজতে পারা গেল এ ছেলেরা ওই খেলা নিয়ে বাজি ধরেছে। একজন বলল, ‘আমি ১০০০ ধরেছি, আর্জেন্টিনা হারবেই। ওরা এ বিশ্বকাপে টিকতেই পারবে না।’ বিষয়টা দেখে খটকা লাগলো এ প্রতিবেদকের। পরিচয় গোপন রেখে বাজির বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়ে কথা বললেন ছেলেগুলোর সঙ্গে। ওদের সবাই স্থানীয় একটি স্কুলের মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র।
বাজির বিষয়ে জানতে চাইলে ওদের একজন জানায়, বিশ্বকাপের প্রায় প্রতিটি খেলা নিয়েই এলাকায় জুয়ার আসর বসে। তবে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মানি বা ফ্রান্সে মতো বড় দল, বাংলাদেশে যেগুলোর সমর্থক বেশি সেসব দলের খেলার দিন জুয়ার অঙ্ক বড় আকার ধারণ করে। এ কিশোর জানায়, ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার খেলার দিন জুয়ার খেলাও জমে বড় আকারে।
জুয়ার ধরন সম্পর্কে জানতে চাইলে এ কিশোররা চমকপদ কিছু জুয়ার ধরন সম্পর্কে ধারণা দেয়। এক এক এলাকায় জুয়া নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি সিন্ডিকেট থাকে। রাজনৈতিক ছত্রছায়াতেই এইসব সিন্ডিকেট পরিচালিত হয়। কিছু হয় খেলার আগে, এটাকে বলে প্রিপেইড আবার কিছু হয় খেলার সময় যাকে বলে পোস্টপেইড। খেলার আগে বলতে যেদিন খেলা সেদিন সকাল থেকেই জুয়ার বিট (অর্থের পরিমাণ) সংগ্রহ করা শুরু হয়। যারা জুয়ার আয়োজন করে তাদের কাছে সকাল থেকেই জুয়ারিরা দলের নামে টাকা জমা দিয়ে আসে। কেউ ৫০০, কেউ ১০০০ কেউ আরও বেশি। দল জিতলেই টাকা দ্বিগুণ আর হারলে টাকা চলে যাবে আয়োজকদের পকেটে। আর খেলার সময় যেটা চলে সেখানে জুয়ারিরা সবাই একসঙ্গে বসে খেলা দেখে। সেখানে অনেকগুলো বোর্ড থাকে। প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন জুয়ার প্লট তৈরি হয় তখন। যেমন- কোন দল জিতবে, কে গোল দেবে, প্রথমার্ধে গোল হবে কি-না, শেষার্ধে গোল হবে কি-না, অতিরিক্ত সময়ে গোল হবে কি-না, পেনাল্টি মিস হবে কি-না এমন বিভিন্ন বিষয়ে বাজিতে টাকা লাগায় জুয়ারিরা।
খবর নিয়ে দেখা গেছে, আনুষ্ঠানিক আসর ছাড়াও অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেকেই জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন বিশ্বকাপ ফুটবলের বিভিন্ন খেলা নিয়ে। বিভিন্ন চা দোকান সেলুন আড্ডার জায়গায় অনেকেই নিজেদের মধ্যে বাজি ধরছেন খেলা নিয়ে। শহর ছাড়াও গ্রাম এলাকায় ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে এ জুয়া খেলা। গ্রামের বিভিন্ন চায়ের দোকানই এসব জুয়ার প্রধান আসর বসে। শিশু ধেকে বয়স্ক অনেকেই খেলা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বাজি ধরছে। কিন্তু তারা নিজেরাও হয়তো বুজতে পারছে না যে তারা খেলার ছলে জুয়ার মতো ঘৃণ্য খেলায় মেতেছে। গ্রাম এলাকায় এক একটি বাজির অর্থ হয় ১০ টাকা থেকে কয়েকশ’ টাকা পর্যন্ত।
রাজধানীর আরামবাগ এলাকার ক্লাব পাড়ার ফুটবল ক্লাবগুলো সারা বছরই হাউজি খেয়ায় ব্যস্ত থাকে। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পর থেকেই নাকি এসব ক্লাবগুলোতে ফুটবল ম্যাচগুলো নিয়ে জুয়ার আসর বসতে শুরু করেছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্লাবেই আলাদা করে খেলা দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে আর যারা খেলা নিয়ে বাজি ধরেন তারাই মূলত খেলার দর্শক। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জুয়াড়ি বলেন, আগে এসে এখানে হাউজি খেলতাম। এখন তো নতুন খেলা। বিশ্বকাপ নিয়েই খেলা চলছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতেও খেলা নিয়ে এমন বাজি ও জুয়ার খবর পাওয়া গেছে। হলগুলোর প্রভাবশালীদের দখলেই বসে এসব জুয়ার আসর যাতে অংশ নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সে সঙ্গে রাজধানীর অভিজাত এলাকার বিভিন্ন হোটেলেও এসব জুয়ার আসর বসে বলে খবর পাওয়া গেছে। ধনী ব্যবসায়ীরা শখের বসে কেউবা নেশার বসে এসব জুয়ায় অংশ নেয়।

Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 3:12 am
বিশ্বকাপ নিয়ে দেশে জমজমাট জুয়া খেলা
পত্রিকা ♦ প্রকাশ: