Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 8:38 pm

বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিব

কাজী সালমা সুলতানা: আজ ১৫ আগস্ট। বাঙালির জাতীয় জীবনে এক শোকাবহ দিন। এদিন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ও বিশ্ব রাজনীতির অবিসংবাদিত নেতা, ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বিশ্ব মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণিত, বর্বর ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড এটি। 

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ক্রীড়ানক, উচ্চাভিলাষী ক্ষমতা লোভী সেনাবাহিনীর  কিছু সদস্য বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এ সময়ে ওই বাসভবনে অবস্থানকারী পরিবারের অন্যদেরও নির্মমভারেব হত্যা করা হয়। এদিন খুনিরা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ আবু নাসের, জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মনি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও তার মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ শিশুপুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু ও বঙ্গবন্ধুর জীবনরক্ষায় এগিয়ে আসা প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।

ইতিহাসের নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ডের ফলে কর্মদীপ্ত এই মহান নেতা ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পরিণত হয় মহান নেতার জীবনের শেষ কর্মদিন। এদিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি ব্যস্ততম দিন পার করেন। এদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি পার্ক চুং হির বিশেষ দূত। এরপর আসেন নৌ-বাহিনী প্রধান মোশাররফ হোসেন খান। সাক্ষাৎ করেন তথ্য ও বেতার মন্ত্রী এম কোরবান আলী। এরপর একসঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ারভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার বীরউত্তম। দেখা করেন সদ্য বাকশালে যোগদানকারী পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের দুই মেয়ে। লন্ডনে চিকিৎসাধীন প্রবীণ নেতা আতাউর রহমান খানের চিকিৎসার খোঁজখবর নিতেই রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসায় বার্তা পাঠান। এ কারণে তার দুই কন্যা দেখা করতে আসেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে।

দুপুরে বঙ্গবন্ধু কৈ মাছ দিয়ে ভাত খান বঙ্গবন্ধু। খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নেন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে গণভবনের লেকের পাড়ে যান। একটু পর সেখানে এসে হাজির হন তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর (বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী) পাশে থাকা চেয়ারে বঙ্গবন্ধু তাকে বসতে বলেন। ওই সময় লেকে সাঁতার শিখছিল রাষ্ট্রপতির শিশুপুত্র শেখ রাসেল। সাঁতার প্রশিক্ষক ছিলেন একজন নায়েক সুবাদার। বঙ্গবন্ধু রাসেলকে বলেন, ‘উনি তোমাকে সাঁতার শিখাচ্ছেন সে জন্য তাকে তোমার তো কিছু উপহার দেয়া উচিত।’

রাসেল হেসে আবার সাঁতার কাটতে চলে যায়। তাহের উদ্দিন ঠাকুর যাওয়ার সময় রাসেলকে ধরে চুমো খেয়ে আদর করেন এবং পরক্ষণেই চলে যান। এর পরপরই আসেন শিক্ষা মন্ত্রী ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মোকাম্মেল হক। তিনি রাষ্ট্রপতিকে একটি মানপত্র দেখান, যা পরের দিন ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে শিক্ষার্থীরা পাঠ করবে। পরক্ষণেই এসে হাজির হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. আব্দুল মতিন চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাদের অবহিত করেন। একটু পর আসেন অন্যতম মন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত। রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব কর্নেল জামিল এসে দেখা করেন। তিনি ডিজিএফআইয়ের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় মূলত বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দোয়া চাইতে আসেন।

রাষ্ট্রপতির অত্যন্ত স্নেহভাজন ফরাসউদ্দীন আহমদ ও মনোয়ারুল ইসলাম উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাবেন। এজন্য ১৪ আগস্ট রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের কর্মকর্তারা একটি নৈশভোজের আয়োজন করেন। বঙ্গবন্ধু সাড়ে ৮টার দিকে নিজ বাসভবনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তার সঙ্গে ছিলেন একান্ত সচিব রেজাউল হায়াত।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি- ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীরা স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধকে পদদলিত করে উল্টো পথে সেই পাকিস্তানি ভাবধারার দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের জš§দাতা বাংলাদেশেই নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীচক্রদের দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হয় ও শান্তি কমিটি রাজাকার আলবদর-শামসদের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানো হয়। একদিকে সামরিক শাসন অন্যদিকে স্বাধীনতা বিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের মাধ্যমে দেশটিকে পেছনের পথে যাত্রা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করতে করা হয় ইনডেমনিটি আইন।  

পঁচাত্তরের পর থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত বাংলাদেশের আকাশে ওঠেনি একাত্তরের সূর্য। শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করেন। দীর্ঘ ২১ বছর পরে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য শুরু হয় ও অপরাধী ৫ জনের ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বাকি ছয়জন এখনও বিভিন্ন দেশের আশ্রয়ে পলাতক।

বাঙালির জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ গড়ার কারিগর শেখ মুজিব। কিশোর বেলা থেকে ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে ষাটের দশকে হয়ে ওঠেন বাঙালির নেতা, বাংলাদেশ গড়ার মুখ্য কারিগর। সংগ্রামের দীর্ঘ পথযাত্রায় সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের রাজনীতি করার অপরাধে তাকে মোট ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে থাকতে হয়েছে। পরিণত হন বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতায়। 

এই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের হাতিয়ার ছিল জাতীয়তাবাদ। এই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অনুপ্রেরণা ছিল জয়বাংলা। এই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের লক্ষ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এই মুক্তিযুদ্ধে একক নেতৃত্বে ছিল সেদিনের জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটাই হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। এই ইতিহাস খন্ডন করা এই ইতিহাস মিথ্যাভাবে উপস্থাপন করা, এই ইতিহাস আংশিক বা অতিরঞ্জিত করার কোনো সুযোগ নেই (কাজী আরেফ আহমেদ)। 

‘একদম নি¤œ পর্যায়ের কর্মী থেকে ক্রমাগত নেতৃত্বে অধিষ্ঠান হওয়ায় তার (শেখ মুজিবুর রহমানের) মাঝে গড়ে উঠেছিল এক আত্মবিশ্বাস। সে আত্মবিশ্বাস শত দোদুল্যমানতার মাঝে জনগণের পক্ষে এবং প্রতিপক্ষের সামনে নির্ভীক থাকতে সাহায্য করেছে; যা রাজনীতি আন্দোলন ও সংগঠনের ক্ষেত্রে পুরোনো সব ধারণা অতিক্রম করে নতুন মাত্রা সংযোজন করতে সহায়তা করেছে। পরিবর্তিতকালে একবার এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণের আগে সভাপতির ভাষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক শেখ মুজিবকে রাজনীতি বিষয়ে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব তার প্রধান অতিথির ভাষণে সম্মান দেখিয়েই বলতে পেরেছিলেন, ‘স্যার আপনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডক্টরেট আর আমি আন্দোলন ও সংগঠনের ডক্টরেট; এমন আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠার পেছনে ছিল সাধারণ কর্মী থেকে নেতা হওয়ার কারণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। জনসভায় রাজনীতিকে জনগণের বোধগম্য ভাষায় তুলে ধরতে পারার অনন্য ক্ষমতা জনগণের মাঝে আশার আলো সহকর্মীদের সামনে তুলে ধরতে পারা। নেতা ও কর্মীর মাঝে রাজনীতির বাইরেও  যে একটি আত্মিক সম্পর্ক থাকে তা প্রতিষ্ঠিত করা। ফলে নেতাদের সাধারণত যে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করা হতো, তা রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়। নেতাকর্মীদের ‘মুজিব ভাই’ সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা পায়। সংগঠন ও নেতৃত্ব গণতন্ত্রায়নের পথে এক ধাপ এগিয়ে যায়। (মনিরুল ইসলাম)

বিশ্ব নেতারা বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে মূল্যায়ন করেছেন। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো তার সম্পর্কে বলেছেন, আমি হিমালয় দেখিনি তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো। ফিলিস্তিন নেতা ইয়াসির আরাফাত বলেছেন, আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, শেখ মুজিব ছিলেন খুবই ভাবাবেগপ্রবণ, হৃদয়বান ব্যক্তি। একজন আইনপ্রণেতার চেয়ে বেশি পরিমাণে ছিলেন পিতৃসুলভ।

১৯৭৩ সালে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তিপদকে ভূষিত করে। পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশচন্দ্র তাকে এই সম্মাননায় অভিষিক্ত করে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আজ থেকে বিশ্ববন্ধু। বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে শুধু বঙ্গবন্ধু নন, তিনি আজ সত্যিই বিশ্ববন্ধু।

গণমাধ্যমকর্মী

salma15august@gmail.com